• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
রাজনীতিকদের সম্পর্ক

মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু

সংগৃহীত ছবি

মতামত

রাজনীতিকদের সম্পর্ক

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

দিন কয়েক আগে কাজী জাফর আহমদের আত্মজীবনী ‘আমার রাজনীতির ৬০ বছর : জোয়ার-ভাটার কথন’ পড়ছিলাম। পড়ছিলাম বলাটা ঠিক হলো না, আসলে বলা উচিত, ঘাঁটছিলাম। যেসব বিষয়ে কৌতূহল বা জানার আগ্রহ হচ্ছিল সেগুলোই শুধু পড়ে দেখছিলাম। ৪৫৫ পৃষ্ঠার বইটিতে বর্ণিত অনেক ঘটনা আমার জানা। ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে অনেক ঘটনায় আমি অংশও নিয়েছিলাম। তা ছাড়া বিশেষ করে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলাম বলেও কাজী জাফরের বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাই করাকে নিজের দায়িত্ব মনে করেছি। স্বাধীনতার পর ভাসানী ন্যাপের প্রথম সাধারণ সম্পাদক (১৯৭২-’৭৪) এবং পরবর্তীকালে প্রথমে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের শিক্ষামন্ত্রী (১৯৭৭) এবং পরে জেনারেল (অব.) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিন্দিত এবং বিতর্কিত এই রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান বিরোধী ১১ দফাভিত্তিক ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সম্পর্কও ছিল তখন থেকেই।

আমাদের সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ছিল মওলানা ভাসানীর অনুসারী। বর্তমান সরকারের মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নাম বেশি প্রচার পেলেও সংগঠনের প্রকৃত প্রধান নেতা ছিলেন কাজী জাফর। ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ প্রাদেশিক রাজনীতিতে প্রথমে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন কাজী জাফর (তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক)। পরবর্তীকালে অনেক বেশি পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি টঙ্গীর ভাসানীপন্থি শ্রমিক নেতা হিসেবে। কাজী জাফর এবং তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া (১৯৯০-এর দশক থেকে ২০০৭ পর্যন্ত বিএনপির মহাসচিব), মোস্তফা জামাল হায়দার প্রমুখ পাকিস্তানে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

কিন্তু তাত্ত্বিক এবং রণনীতি ও রণকৌশলগত বিভিন্ন প্রশ্নে মতপার্থক্যের কারণে তারা সেকালের চীনপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে আসেন (কারো কারো মতে তাদের বের করে দেওয়া হয়েছিল)। কাজী জাফরের নেতৃত্বে এরপর ১৯৬৯ সালে গঠন করা হয় ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’। তাদের ঘোষিত কর্মসূচি ছিল ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত এক জনসভায় এই সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকেই সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ তথা পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার এবং স্বাধীন সে রাষ্ট্রে জনগণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়েছিল।

পাকিস্তানের সংহতিবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের আহ্বান জানানোর অভিযোগে সামরিক আদালতের বিচারে কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। দুজনের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ দিয়েছিল সামরিক আদালত। কিন্তু উভয় নেতাই ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যাওয়ায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে পল্টন ময়দানের জনসভায় সভাপতিত্বকারী ছাত্রনেতা মোস্তফা জামাল হায়দার এবং সংঠনের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহকে সামরিক আদালতের বিচারে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছিল। জামাল হায়দার ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে পারলেও মাহবুবউল্লাহকে সরকার গ্রেফতার করতে পেরেছিল। তাকে জেলের ভাতও খেতে হয়েছে।  

নিবন্ধের এ পর্যন্ত এসে পাঠকদের মনে আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে। না, বিতর্কিত এমনকি নিন্দিত রাজনীতিক কাজী জাফরের আত্মজীবনী প্রধান বিষয়বস্তু নয়। বিষয়বস্তু আসলে রাজনীতিকদের মধ্যকার সম্পর্ক। এর আগের কয়েকটি নিবন্ধে আমি মওলানা ভাসানী এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রসঙ্গে লিখেছি। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, প্রকাশ্য রাজনীতিতে মতপার্থক্য ও বিরোধিতা থাকলেও এই দুই মহান জাতীয় নেতার প্রকৃত সম্পর্ক ছিল পিতা ও পুত্রের মতো। দুজনের রাজনৈতিক বিরোধিতার মধ্যে যেমন অভিনয়ের বা লোক দেখানোর কোনো উপাদান ছিল না, তেমনি তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল নিখাদ। পিতা ও পুত্রের মতো ওই সম্পর্কে কোনো রকম কপটতা বা অসততা ছিল না।

এটাই যে একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্য অনেক নেতার সম্পর্কের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ছিল— সে সম্পর্কে কাজী জাফরও তার আত্মজীবনীতে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গেও প্রথমে ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিব সম্পর্কিত দু’-একটি তথ্য বা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হবে। খাদ্য-বস্ত্রের মূল্য হ্রাস, দমননীতির অবসান এবং জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ তিন দফা দাবিতে ১৯৭৩ সালের ১৫ থেকে মওলানা ভাসানী আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন। ৯০-এর বেশি বয়সী ‘পিতার মতো’ নেতার অনশনে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব। অনশনের তৃতীয় দিনই তিনি নিজে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন মতিঝিলে অবস্থিত ভাসানী ন্যাপের কেন্দ্রীয় অফিসে। উদ্দেশ্য, নেতার অনশন ভাঙানো। এজন্য নিজের সঙ্গে এক গ্লাস দুধও নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানিয়ে মওলানা ভাসানীকে তিনি বলেছিলেন, ‘মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। এ সময় অনশন করাটা আপনার মোটেও ঠিক হয়নি। ...আপনি দেশের খাদ্য পরিস্থিতির কথা বলেছেন, সেটা আমি দেখব। আপনি অনশন ভঙ্গ করেন।’

বঙ্গবন্ধুর আবেগ মিশ্রিত অনুরোধে মওলানা ভাসানী অনশন ভঙ্গ করতেন কি না সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে, কিন্তু ভাসানী ন্যাপের সেক্রেটারি হিসেবে কাজী জাফর প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, আগে আপনি তার তিন দফা মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিন। তারপর তাকে অনশন ভঙ্গ করতে রাজি করানো যাবে। কাজী জাফরের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং তার ও মওলানা ভাসানীর কথার মধ্যে ইন্টারফেয়ার করতে নিষেধ করেন। কাজী জাফর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তর্কেও জড়িয়ে পড়েন। এ সময় মতিঝিলে ন্যাপ অফিসের সামনে বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে। কাজী জাফর দাবি করেছেন, স্লোগানগুলো ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এসবের সঙ্গে তার নিজের বা ন্যাপের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব অসম্মানিত বোধ করেন এবং অত্যন্ত ক্ষুব্ধ অবস্থায় ভাসানী ন্যাপের অফিস থেকে বেরিয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে এক পর্যায়ে কাজী জাফরকে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি যদি কথা বলতে চাও, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসো। অফিসে আসতে পার, গণভবনে আসতে পার, বাসাতেও আসতে পার।’

মওলানা ভাসানীর অনশনকেন্দ্রিক তথ্যগুলো কাজী জাফরের আত্মজীবনী গ্রন্থের ২৩৮-২৪৩ পৃষ্ঠায় রয়েছে। এসব উল্লেখ করার উদ্দেশ্য অন্য একটি ঘটনার কথা জানানো— যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর উদারতার প্রকাশ ঘটেছিল। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জানানো দরকার, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজী জাফরসহ হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেননদের বহু বছর ধরেই প্রকৃতপক্ষে ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিক থেকেই পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কাজী জাফররা বঙ্গবন্ধুকে যথেষ্ট সম্মান করতেন। তার ৩২ নম্বরের বাসভবনেও তারা গেছেন। কিন্তু যখনকার ঘটনা বলা হচ্ছে তখন বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের নেতা নন, দেশের প্রধানমন্ত্রীও। অন্যদিকে দল হিসেবে ভাসানী ন্যাপ ছোট হলেও মওলানা ভাসানীর কারণে দলটির ব্যাপক প্রভাব ও পরিচিতি ছিল। কাজী জাফর ছিলেন সে ন্যাপেরই সেক্রেটারি। তার বয়সও তখন মাত্র ৩০-এর কোঠায়। সুতরাং তার কথায় ও ব্যবহারে ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটে থাকতে পারে। সেটা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে ক্ষুব্ধ ও অসম্মানিত অবস্থায়ও জাতির প্রকৃত একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কিন্তু কাজী জাফরকে তার সঙ্গে দেখা করতে ও কথা বলতে বলেছেন— অফিসে, গণভবনে এবং বাসভবনের যেখানে খুশি যেতে বলেছেন। এখানেই ছিল বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা।

এবার সেই ঘটনা প্রসঙ্গ, যা শোনানোর জন্য এত কথা বলা। আগেই জানিয়েছি, কাজী জাফর টঙ্গীর একজন ডাকসাইটে শ্রমিক নেতা ছিলেন। ১৯৭৩ সালেরই কোনো একসময় রিলিফের কম্বল বিতরণ নিয়ে কাজী জাফরের শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে জাতীয় শ্রমিক লীগের ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সহযোগিতায় শ্রমিক লীগের সদস্যরা সাধারণ শ্রমিকদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের গুলিতে কয়েকজনের মৃত্যুও ঘটে। কাজী জাফর গিয়ে একটি মিলের জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে আশ্রয় নেন। শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা সেটা জেনে যান। তারা কাজী জাফরকে আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। কাজী জাফর জিম্মি হয়ে পড়েন।

বিপন্ন অবস্থায় কাজী জাফর তখন বঙ্গবন্ধুর বাসায় তার ব্যক্তিগত নাম্বারে টেলিফোন করেন। ওই মুহূর্তে বাসায় না থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু এসে কথা বলেন। তার কাছে রিপোর্ট গিয়েছিল- কাজী জাফরের নেতৃত্বে শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্যরা টঙ্গীতে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালিয়ে রিলিফের কম্বল লুট করেছে এবং দলের অফিসে ভাঙচুর চালিয়েছে। সে কারণে প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু খুবই উত্তেজিতভাবে কাজী জাফরকে ধমক দিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি বলার পরও কাজী জাফর কেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি এবং সামনাসামনি কথা বলেননি। সেদিনও টেলিফোনে তিনি সাক্ষাৎ করতে এবং সামনাসামনি কথা বলতে বলছিলেন। জবাবে কাজী জাফর বলেছিলেন, ‘যদি বাঁচি তাহলে দেখা হবে।’ কথাটা শুনেই বঙ্গবন্ধুর সুর পাল্টে গিয়েছিল। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ এবং ভীত-সন্ত্রস্ত কাজী জাফরের বক্তব্য শোনার পর বঙ্গবন্ধু ‘তুমি’ না বলে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তুই কোথায় আছিস?’ 

কাজী জাফরের কাছ থেকে ওই মিলের জেনারেল ম্যানেজারের টেলিফোন নাম্বার জেনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দশ মিনিট পর তিনি তাকে ফোন করবেন। কিন্তু ফোন করেছিলেন তিনি ১৫-১৬ মিনিট পর। খুবই উদ্বিগ্ন অবস্থায় কাজী জাফরকে বলেছিলেন, টেলিফোনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তেমন কাউকে পাননি বলে এবং মন্ত্রীদের খুঁজতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে বলে তিনি নিজে টঙ্গী থানার ওসিকে ফোন করে আদেশ দিয়েছিলেন, ‘তুমি এক্ষুণি যাও’। বলেছিলেন, ‘কাজী জাফরকে তুমি সসম্মানে নিয়ে আসবে। এর জন্য যা যা করা প্রয়োজন তোমাকে তা করতে হবে।’

কাজী জাফর জানিয়েছেন, কয়েক মিনিটের মধ্যে দু’তিন ট্রাক পুলিশসহ টঙ্গী থানার ওসি স্বয়ং এসে হাজির হয়েছিলেন। তার নির্দেশে পুলিশ সরকার সমর্থক শ্রমিক লীগের লোকজনের ওপর গুলি চালানো শুরু করেছিল। উভয় পক্ষেই বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছিল। বিস্মিত কাজী জাফর লিখেছেন, ‘এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। পুলিশ আমাদের পক্ষে (অর্থাৎ সরকারবিরোধীদের পক্ষে) গুলি করছে!’ গোলাগুলি চলার মধ্যেই টঙ্গী থানার ওসি কাজী জাফরের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে নিজে টেলিফোন করেছেন। আপনাকে সসম্মানে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ কাজী জাফর আরো লিখেছেন, ‘সে (ওসি) তখন থরথর করে কাঁপছিল। ...কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলো। ...ঢাকায় এসে আমি (প্রধানমন্ত্রী) শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি।’

প্রসঙ্গক্রমে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কাজী জাফরের মূল্যায়নও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার। তিনি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অনেক সমালোচনা আমাদের আছে। কিন্তু এ কথা সত্য, মাথা থেকে পা পর্যন্ত তিনি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন।...সকল রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি তাঁর একটা দুর্বলতা ছিল। যখনই তিনি দেখেছেন, আমার জীবন হুমকির মুখে তখনই তিনি আমাকে বাঁচানোর জন্য যা করা প্রয়োজন তা করেছেন। রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ছিল সে কারণেই তিনি আমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছেন। এটা তাঁর হূদয়ের একটা ঔদার্য, বিশালতা— এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।’ (পৃষ্ঠা— ২৫২-২৫৫)।

এভাবেই মূল্যায়নের আড়ালে কাজী জাফর তার আত্মজীবনীতে সেকালের রাজনীতিকদের মধ্যকার আন্তরিক সম্পর্ক সম্পর্কে জানিয়েছেন। আসলেও একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল আপনজনের মতো। এ বিষয়ে আরো কিছু ঘটনার উল্লেখসহ আগামীতে লেখার ইচ্ছে রইল।

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads