• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

অন্তঃশূলে হন্তদন্ত শিক্ষিত বেকার

  • ওমর ফারুক শামীম
  • প্রকাশিত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ছোটবেলা থেকে ছেলের মেধা দেখে বাবার মনে স্বপ্ন জাগে— উচ্চ শিক্ষার জন্য সবকিছু দিয়েই চেষ্টা করবেন। করেছেনও। দিনমজুর বাবা গায়ে খেটে ছেলেকে আইএ পাস করিয়েছেন। এরপর আর খরচ জোগাতে পারেননি। এটাই বা কম কিসের। বাবার লালিত স্বপ্ন মেধাবী ছেলেটিও মনের ফ্রেমে বাঁধাই করে রেখেছিল। অতঃপর দুঃখ কষ্টের সিঁড়ি ভেঙে একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হলো সে। স্বপ্ন তার আকাশ ছুঁয়ে গেল। দরিদ্র বাবার ঋণের অর্থে ছেলে ভর্তি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর নিজের চেষ্টায় স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে চলছে শিক্ষাজীবন-চলছে টিউশনি।

দরিদ্র বাবার স্বপ্নের জাদুকর কৃতিত্বের সঙ্গে বাংলায় অনার্স সম্পন্ন করে মাস্টার্সও পাস করলেন। এবার সংসারের হাল ধরার পালা। সরকারি চাকরির জন্য ছোটাছুটি, প্রাণান্তকর চেষ্টা। না, কিছুতেই কিছু হলো না। এ যেন সোনার হরিণ— এমন কঠিন বাস্তবতা জানাই ছিল না তার। ‘মেধা থাকলে চাকরি একদিন হবেই’— এই বিশ্বাসে দৌড়ঝাঁপ দিতে দিতে বছরের পর বছর কেটে গেল। সরকারি চাকরি জুটল না দরিদ্র ঘরের স্বপ্নের জাদুকর ‘রবি রতন’-এর ভাগ্যে!

যে বছর সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা শেষ হলো— সে বছরটি ছিল রবি রতনের জন্য শোকাবহ। এই শোক স্বজন হারাবার শোক নয়। দীর্ঘ বছর ধরে যত্নে লালিত সেই ‘স্বপ্নে’র মৃত্যুশোক! শোকে শোকেই জীবনের গতি হারিয়েছে শিক্ষিত বেকার ‘রবি রতন’। জীবন বদলে গেছে অনিয়মের শিকলে। আশাহত ‘রবি রতন’ ও তার পরিবার জীবন পার করছে একমাত্র ছেলের টিউশনির উপার্জনে।

ভারতীয় গীতিকার ভবেশ কুণ্ডুর লেখা ‘তোমরা যতই আঘাত করো নেইতো অভিমান’ গানটির একটি লিরিক— ‘নাম না জানা অনেক ফুলই পথের ধারে ফোটে, জীবনটা যায় ঝরে ঝরে ফুলদানি না জোটে’। গানের এই সত্যি কথাগুলো এ দেশের অনেক চাকরিপ্রত্যাশী দরিদ্র মেধাবী শিক্ষিত বেকারের সঙ্গে মিলে যায়! মিলে গেছে মেধাবী রবি রতনের বেলায়ও। এ আমাদের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী!

শিক্ষিত যুবকদের স্বপ্নভঙ্গ আর শোকাচ্ছন্ন হওয়ার এমন ঘটনা একটি দুটি নয়, লাখ লাখ! সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একদিকে কোটা, অন্যদিকে নানান অনিয়মের কথা আমরা সবাই জানি। কোথায় যাবে মেধাবীরা? যে মেধা মূল্যায়িত হবে না! তাহলে কেনই বা মেধার চর্চা হবে?

আমরা জানি— একটি দেশের দায়িত্বভার তাদের হাতেই গড়ায়, যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে নিযুক্ত হন। এই চাকরিজীবীরা যদি হয় মেধাবী, সৎ ও নিষ্ঠাবান; তাহলেই রাষ্ট্রের কল্যাণ, আর যদি হয় মেধাহীন, অদক্ষ ও অযোগ্য, তাহলে সে দেশে উন্নয়ন যতই হোক তা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না।

আলোচনা প্রাসঙ্গিক যে, সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটায় নিয়োগের পর বাকি থাকে ৪৪ শতাংশ। এই ৪৪ শতাংশ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও আছে অনিয়মের নানান অভিযোগ। যে কারণে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্যদের সেবা পাওয়া থেকে। কোটা পূরণ করতে গিয়ে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার যোগ্য মেধাবীরাও। হতাশায় আছেন লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। অন্তঃশূলে হন্তদন্ত হয়ে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছেন শিক্ষিত বেকারদের অনেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত কয়েক মাসে দেশে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিলের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছে এবং এই নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের সুপারিশ করেছে। সরকারের এ উদ্যোগে শিক্ষিত বেকাররা মেধা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন দ্বার খুলবে বলে মনে করছেন।

সচেতন মহল দাবি করছে— মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবার এবং অনগ্রসর যারা রয়েছেন তাদের সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হোক। তবে প্রশ্ন আছে, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের যারা কোটায় সুযোগ পাচ্ছেন- তাদের কত শতাংশ প্রকৃত মুুক্তিযোদ্ধা? প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা বঞ্চিত হয়েছেন এমন অভিযোগও আছে। মেধাবীরা বলছেন— কয়েক যুগ ধরে কোটায় গিলে খেয়েছে তাদের মেধার অধিকার।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে ভালো রেজাল্ট করেও প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাচ্ছে না অনেক মেধাবী। বিসিএসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বার বার পরীক্ষা দিয়েও আশাহত হন হাজারো মেধাবী তরুণ-তরুণী। অথচ কম মেধা, কম যোগ্যতা এবং পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া ব্যক্তি একবার পরীক্ষা দিয়েই সুযোগ পাচ্ছেন প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে। মেধাবীদের কাছে এই দৃশ্য অসহনীয় বেদনার এক অন্তঃশূল। কোটা বাতিলে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ছাত্রদের আন্দোলনও একটি সাফল্য অর্জন করবে।

এক অভিভাবকের কষ্টের কথা— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও বিসিএসে চান্স না পাওয়া যে কত কষ্টের, তা বলে বোঝানো যাবে না। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া অনেক বড় চাকরি পাওয়ার চেয়েও কঠিন কাজ। এখানে চান্স পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করতে হয়। ভালো ফলের পরও অনেক অধ্যয়ন করতে হয় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। এত কিছুর পরও পাস করে যদি বেকার বসে থাকতে হয়! এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী হতে পারে? এসব মেধাবী শিক্ষিত বেকারের সামনেই আবার অযোগ্যরা বড় বড় সরকারি চাকরি পায়! এমন কষ্টের আক্ষেপ এ দেশে সমুদ্র সমান।

কোটা পদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ২ দশমিক ৬৩ শতাংশের জন্য ৩৬ শতাংশ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি বরাদ্দ রয়েছে। কোটা সংস্কারআন্দোলনকারীদের প্রচারপত্রে বলা হয়— বর্তমানে দেশের ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিমাণ হলো ১ দশমিক ১০ শতাংশ। আর তাদের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি বরাদ্দ রয়েছে ৫ শতাংশ। প্রতিবন্ধী জনসংখ্যার হার ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১ শতাংশ চাকরি।

অন্যদিকে মোট জনসংখ্যার বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পোষ্যদের সংখ্যা হলো দশমিক ১৩ শতাংশ। এদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০ শতাংশ চাকরি। এভাবে মোট জনগোষ্ঠীর সামান্য অংশের জন্যই (মাত্র ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৬ শতাংশ চাকরি।

এদিকে বিসিএসে বর্তমানে প্রতি ১০০ জনে ৫৬ জন চান্স পায় কোটার মাধ্যমে। বিসিএস ক্যাডার ছাড়াও প্রথম শ্রেণির আরো সরকারি চাকরি রয়েছে। তারা নন-ক্যাডার। প্রথম শ্রেণির এই নন-ক্যাডার এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও রয়েছে ৫৬ শতাংশ কোটা পদ্ধতি। এর বাইরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটার হার আরো বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়।

আবার ৫৬ শতাংশ এই কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পোষ্যদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ থাকে।

দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের সঙ্গে এই কোটা পদ্ধতি বহুগুণে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও চরম বেদনার। কারণ এই বৈষম্য দেশের নীতিনির্ধারকরাই তৈরি করেছিলেন। কোটা বৈষম্যের এ কথা ভেবে সচেতন দেশবাসী হা-হুতাশ করেন। অনগ্রসর সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য ১৯৭২ সালে কোটা পদ্ধতি চালু হলেও বৈষম্য দূর করার এই কোটা-ই আবার বৈষম্যের হাতিয়ারে পরিণত হয়।

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে যেমন ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে, তেমনি আরো ভয়াবহ তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কোটা রয়েছে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, নারী ১৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, আনসার ও ভিডিপি ১০ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১০ শতাংশ। প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী কোটা মিলিয়ে প্রায় ৯৬ শতাংশই কোটা রয়েছে। রেলওয়েতে ৮২ শতাংশ কোটা রয়েছে; এর মধ্যে ৪০ ভাগ পোষ্য কোটা, যা নজিরবিহীন বলছেন আন্দোলনকারীরা। দেশের বর্তমান জনগোষ্ঠী আর পরিস্থিতির সঙ্গে ১৯৭২ সালের বাস্তবতার কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। তখনকার সাত কোটি মানুষের জন্য সৃজিত এই কোটা পদ্ধতি বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে বড় রকমের বৈষম্যই তৈরি করেছে। যেসব অনগ্রসর সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য এই কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, সেসব মানুষ এখন অগ্রসর। সুতরাং কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে সবাইকে মেধার ভিত্তিতে যোগ্যতা প্রমাণের পথ সুগম করে দেওয়াই হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তাই কোটা বিষয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দেরিতে হলেও শিক্ষিত বেকারদের জন্য সুসংবাদই বটে। কারণ বর্তমানে দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বেকার সরকারি চাকরি না পেয়ে অস্থির সময় পার করছেন। রিকশা চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করছেন অনেক শিক্ষিত বেকার! এমন নজির খোদ রাজধানীতেই আছে। উন্নয়নশীল কাতারের তালিকায় থাকা একটি দেশের শিক্ষিত বেকারদের এমন কর্মদৈন্য দেশের জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়।

 

লেখক : সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

ofshamimbd@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads