• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
বায়ুদূষণে বিপন্ন পরিবেশ

মনুষ্যসৃষ্ট এসব দূষণের কারণে মানুষের প্রাণসংহার ঘটছে অহরহ

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ভিন্নমত

বায়ুদূষণে বিপন্ন পরিবেশ

  • প্রকাশিত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অলিউর রহমান ফিরোজ

পরিবেশের ক্ষতির মধ্যে বায়ুদূষণ অন্যতম। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নির্মল বায়ু অপরিহার্য। কিন্তু বায়ুদূষণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিপন্ন হওয়ায় মানুষ এখন সঙ্কটাপন্ন অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছে। মনুষ্যসৃষ্ট এসব দূষণের কারণে মানুষের প্রাণসংহার ঘটছে অহরহ। রাষ্ট্রের গাফিলতি এবং আইনের সঠিক প্রয়োগে মানুষের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই গড়ে উঠেছে শহরের আশপাশে অনেক ইটভাঁটা। ইটভাঁটার চিমনির বিষাক্ত কালো ধোঁয়া গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব ইটের ভাঁটার কারণে মানুষ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তা ছাড়া রয়েছে নদীপারে গড়ে ওঠা টেক্সটাইল মিলের ডাইং মেশিন। ডাইং মেশিনের কাপড়ের রঙ করা পানি এবং বর্জ্য সরাসরি নদীতে পতিত হচ্ছে। কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে ওঠার নিয়ম থাকলেও তা যথাযথভাবে মানা হয় না। কাপড়ের রঙ মিশ্রিত পানি কারখানার পাশে শোধনাগারে শোধন করে তা নদীতে ছাড়ার কথা থাকলেও কেউই নিয়মের ধার ধারছে না। ঢাকার আশপাশের চারটি নদী এখন দখল এবং দূষণের কবলে পড়ে তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। নদীগুলোতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়ে এখন জলজ প্রাণীর জন্য মরণ ডেকে আনছে। তার কারণে জেলেরা এখন ঢাকার আশপাশের চারটি নদী থেকে কোনো ধরনের মৎস্য আহরণ করতে পারছে না। বিষাক্ত পানিতে কোনো মাছ বা জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। ঢাকার সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে লঞ্চে চলাচল করলেই নদীর আশপাশে শত শত ইটভাঁটা চোখে পড়বে। এভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো অপরিকল্পিতভাবে ইটের ভাঁটা গড়ে ওঠা পরিবেশের জন্য সত্যিই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে ইটভাঁটার কথা বাদ দিলেও সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের জন্য দায়ী দেশের কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। বুড়িগঙ্গা নদীর শেষপ্রান্তে ধলেশ্বরী এবং শীতলক্ষ্যা নদীর পারে গড়ে ওঠা সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ক্লিঙ্কারে পুরো এলাকা শিশিরের মতো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পরিবেশবান্ধব ফ্যাক্টরি হিসেবে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গড়ে না ওঠায় নদীপারের হাজার হাজার মানুষ এখন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। কলকারখানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ইটের ভাঁটা, ডাইং মিল এবং গাড়ির কালো ধোঁয়া রোধ করা কঠিন কোনো কাজ নয়। কিন্তু সঠিক তদারকি এবং নিয়মনীতি ঠিক করে কেউ মানছে না বলেই ঢাকা শহর থেকে শুরু করে গ্রামের মানুষও এখন বায়ুদূষণের প্রভাবে মারাত্মক রোগের সঙ্গী হয়ে পড়েছে। ইটের ভাঁটা যে শুধু নদীপারেই গড়ে উঠছে তা নয়, গ্রামের অনেক ফসলি জমি নষ্ট করেও তা এখন বহাল তবিয়তে চলছে।

পরিবেশদূষণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা থেকে জানা যায়, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই পরিবেশদূষণে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর ৫ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ নানা রোগ-শোকে ভুগছে। তবে এর বেশিরভাগ শিকার হচ্ছে বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিকরা। দূষণের কবলে পতিত হয়ে রাজধানীবাসীর ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণ অন্যতম। বায়ুতে যে পরিমাণ ক্ষুদ্র কণার পিএম থাকার কথা, তার চেয়ে বিরাজ করছে পাঁচগুণ বেশি। বায়ুদূষণের উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে ইটভাঁটা ৫৮ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ১০ শতাংশ, মাটি এবং সড়কের ধুলা থেকে আসে ৮ শতাংশ এবং কাঠসহ নানা ধরনের বস্তু পোড়ানো থেকে আসে ৭ শতাংশ উপাদান।

ঘরের ভেতর বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, স্যানিটেশন দূষণ, কর্মক্ষেত্র দূষণের হিসাব করে সমীক্ষাটি করা হয়েছে। তবে শহরের বস্তি এলাকাগুলোতে স্যানিটেশন দূষণ মারাত্মক অবস্থায় বিরাজ করছে। সেখানকার ব্যবহূত পানিতে মনুষ্য মলের অণুজীব ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। বিশেষ করে বস্তির শিশুরাই নিরাপদ পানির অভাবে বেশি পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাতাসের দূষণ সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তার কারণ বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়ে গেছে গাড়ির কালো ধোঁয়ার কারণে। শহরের রাস্তায় দীর্ঘদিন ধরে অকেজো এবং ফিটনেসবিহীন যান চলাচল করার কারণেই কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। এতে করে শহরের বায়ুতে সিসার পরিমাণ অন্যান্য স্থান থেকে বেশি। ফলে বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট এখন শিশু থেকে বয়স্ক লোকের নিত্যসঙ্গী।

বায়ুদূষণ রোধ করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু প্রভাবশালীরাই মূলত পরিবেশ আইনকে তোয়াক্কা করছে না। অথচ ইটভাঁটা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এবং ডাইং কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। আবার সড়কে ফিটনেসবিহীন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি আটক করা হলে শ্রমিক নেতাদের রোষের আগুনে জ্বলতে হয়। দেশের শহর এবং গ্রামের পরিবেশ সমুন্নত রাখতে হলে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। সুতরাং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের দূষণকেই গুরুতর অপরাধ হিসেবে আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে না পারলে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য চাই পরিশুদ্ধ অক্সিজেন। কিন্তু এখন তা বিষবাষ্পে পরিণত হয়েছে। সুতরাং মানুষের জীবনধারণের জন্য এখন নির্মল পরিবেশই একান্ত প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে আমাদের সম্মিলিতভাবে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads