• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
নির্বাচন ও আমাদের গণতান্ত্রিক অবস্থান

নির্বাচনের আগে যে হারে গণসংযোগ হয় নির্বাচন শেষ হলে তার শতভাগ কমে যায়

আর্ট : রাকিব

মতামত

নির্বাচন ও আমাদের গণতান্ত্রিক অবস্থান

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক উৎসব। এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এদেশের জনগণও চায় সুষ্ঠু, অবাধ, ভয়হীন ও নিরপেক্ষভাবে এ উৎসব পালন করতে। উৎসবকেন্দ্র তথা ভোটকেন্দ্র যেন কোনো সন্ত্রাসীদের উৎপাতের জায়গা না হয় বা কোনো দলের দখলে না থাকে। জনগণ নির্বিঘ্নে আসবে নিজের অধিকার প্রয়োগ করবে। কোনো অস্ত্র-মহড়া চাই না, চাই না রক্তপাত। কিন্তু যা বলা হচ্ছে এগুলো ৪৭ বছর ধরে এদেশের মানুষের আর্তি। গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের শাসন এবং জনগণ হচ্ছে সমস্ত ক্ষমতার উৎস— কথাটি আজ আর বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কারণ প্রতি ৫ বছর অন্তর একবার করে জাতীয়ভাবে প্রতারিত এবং স্থানীয়ভাবে আরো কয়েকবার প্রতারিত হয়ে বিশ্বাস বলে কোনো বিষয় আর জনগণের মনে ঠাঁই পাচ্ছে না। শাসক-শাসিতের মধ্যে প্রতারণা, অবিশ্বাস ও দূরত্ব কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য যেমন ভালো নয় তেমনি সে রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্যও সুখকর হয় না। প্রতারণা থেকে ঘৃণা জন্ম নেয় যা ক্রমে দ্রোহে পরিণত হয়। আর এ থেকে জন্ম নেয় সহিংসতা, উগ্রবাদ ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের। তখন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ দেশের সব ক্ষেত্রে নৈরাজ্য শুরু হয়।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের রাজনীতি ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বেশ গুরুত্ববহ। কিছু পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতা ও রাজনীতিবিদ ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গড়ে তুলেছেন। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও নির্বাচনে জনগণের অধিকার প্রয়োগের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে এমন ঐক্য প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু জনগণের মনে গত ৪৭ বছরের যে অবিশ্বাস বাসা বেঁধেছে তা ভেঙে ফেলা খুব শক্ত। স্বাধীনতার পর এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় জনগণের মনে অবিশ্বাসের শিকড় বেশ গভীরে পৌঁছেছে। ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গঠনকারী দলগুলো জনগণের মনে গজিয়ে ওঠা অবিশ্বাসকে আরো পোক্ত করবে নাকি মূল উৎপাটন করে স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনবে তা দেখার বিষয়।

নির্বাচনের আগে যে হারে গণসংযোগ হয় নির্বাচন শেষ হলে তার শতভাগ কমে যায়। এটা আমাদের দেশে একটা প্রথায় রূপ নিয়েছে। কারণ আমরা যাদের নির্বাচিত করি বা অনেক সময় করিও না, তারপরও নেতা হয়। তারা ‘গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী’ নেতা। তাই ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের যত ইচ্ছা আছে (ভালো-মন্দ) সবই জনগণ ও উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পূরণ করে নেয়। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী জনতার পক্ষে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য থাকে না। কারণ তখন তারা প্রত্যেকেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে রত থাকে। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যা করা হয়ে থাকে, তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে শত দিক থেকে সঙ্কটে নিপতিত করে। যার সবটাই পোহায় আমজনতা।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তারপরও এই দলগুলোই আবার ক্ষমতায় আসে কীভাবে? সমস্যার মূল হলো আমরা ১৯০ বছর ছিলাম পরাধীন। অধিকার সচেতন ছিলাম না। তারপর ২৩ বছর নামে স্বাধীনতা পেয়ে মূলত পরাধীন ছিলাম। এই যে লম্বা সময় পরাধীনতার ঘানি টেনেছি তাতে আমাদের মানসিক দৈন্য একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। স্বাধীনতার পর আমাদের সে দীনতা কাটাবার প্রচেষ্টা হয়নি, আজো হচ্ছে না। তাই যা বুঝিনি সেটাই কামনা করেছি। আর যখন পেয়েছি তখন কাঙ্ক্ষিত বস্তু দ্বারাই ধোঁকার শিকার হয়েছি, হচ্ছি। আমরা ২১৩ বছর পরাধীন ছিলাম (ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল মিলিয়ে)। আর একাত্তরের স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের শিক্ষা পায়নি। গণতন্ত্র দেওয়া নেওয়ার বস্তু নয়। এটা ব্যক্তি জীবন থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে চর্চা করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গণতন্ত্রের শিক্ষাই নেই। আর চর্চার প্রসঙ্গ অবান্তর। বিষয়টা হচ্ছে এখনো ৩০ শতাংশ মানুষ সাক্ষরতার বাইরে। অন্যদিকে ৭০ শতাংশ সাক্ষর মানুষের অধিকাংশই প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত নয়। তারা কেবলই পড়তে জানে। তাদের মধ্যেও গণতন্ত্র নিয়ে স্বচ্ছ কোনো ধারণা নেই। আমাদের শাসকশ্রেণি ও রাজনৈতিক দলগুলো যে গণতন্ত্র নিয়ে রাত-দিন ঘাম ঝরাচ্ছে সেই গণতন্ত্রই বোঝে না রাষ্ট্রের অর্ধেক মানুষ। সুতরাং আমরা যে স্বাধীন হয়েও প্রতারিত হচ্ছি, তা আমাদের প্রাপ্য।

আর তাই আমাদের সামনে গণতান্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদ চেপে বসলেও বুঝতে পারি না। বা বুঝলেও করণীয় জানি না। ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না আমাদের হাতে সব ক্ষমতা থাকার পরও। এই যে দীনতা, তা কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদের এ দেশে গণতন্ত্রের শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের কাজ এ দায়িত্ব পালন করা, যদি তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং তাদের দলীয় আদর্শের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রাখে। কেননা অতীতে আমরা দেখেছি, গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় এসে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার কীভাবে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছিল।

মার্কিন বিপ্লবী লেখক টমাস পেইন তার ‘Main currents in modern political thought’ বইতে একটা সুন্দর কথা বলেছেন, ‘সরকার এক ধরনের প্রয়োজনীয় মন্দলোক।’ তাই আমাদের দেশের বহি ও অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো পরিচালনার জন্য এমন ‘মন্দলোকের’ প্রয়োজন। সেজন্য আমাদের বুঝতে হবে ‘মন্দলোকের’ মন্দত্বের গভীরতা, ব্যাপকতা, সমাজে এর প্রভাব কতটা, ভবিষ্যতে জনগণের অধিকার রক্ষায় এবং দেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তা কতটা প্রভাব বিস্তার করবে। সে হিসাব করেই ‘মন্দলোক’ বাছাই করতে হবে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। আর এই বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে জনগণের ও প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের জন্য ‘মাঠ সমতল’ হতে হবে। যাতে আমরা চিনতে পারি ‘তুলনামূলক ভালো মন্দলোকদের’ আর তারাও যেন আমাদের কাছে এসে তুলে ধরতে পারেন তাদের ভবিষ্যৎ দেশ পরিচালনার রূপরেখা। এবং এদেশের গণতান্ত্রিক উৎসব আমাদের যেন শঙ্কিত না করে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

sadikiu099@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads