• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
ঢাকা : বসবাস অযোগ্য দ্বিতীয় শহর

বসবাসের জন্য সবচেয়ে খারাপ শহরের তালিকায় আবারো স্থান হলো ঢাকার

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ঢাকা : বসবাস অযোগ্য দ্বিতীয় শহর

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

যতই আমরা সামনে এগুতে চাই, ততই যেন পিছিয়ে যাই। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাফেলায় শামিল হয়েছে বাংলাদেশ। এই আনন্দে আমরা বিভোর ছিলাম। মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা কমিয়ে জাতিসংঘের মানদণ্ডে আমরা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠেছি। এই সুখবরের পরপরই পেলাম মর্মদহ খবরটি।

ঢাকার যানজট, পানিবদ্ধতা, মশা, মাছি, দুর্ঘটনা, বিরামহীন রাস্তাখনন ইত্যাকার বহু সমস্যায় আমরা প্রতিনিয়ত জর্জরিত। মাটিতে পানি পড়ার আগেই রাস্তায় এক কোমর পানি জমে যায়, একটি দুটি জায়গায় না, অসংখ্য জায়গায়। এমনকি দেশের অর্থনীতি আর প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়েও। সচিবালয়ের মাঝে মাগুর শিং মাছ ধরা পড়ে। ঢাকার রাজপথ দিয়ে নৌকা চলে। রাপা প্লাজার সামনের রাস্তাটা এখন অনেকেই ‘রাপা নদী’ নামে ডাকে। বস্তিবাসীর জীবন হয় দ‍ুর্বিষহ। এসব বড় পুরনো কথা। যানজটের কথা আর না-ইবা বললাম। পানি থাকে না, গ্যাস থাকে না, বিদ্যুৎ থাকে না। হয়তো মাঝরাতে টিমটিম করে এক চুলোয় একটু গ্যাস আসে। আরেকটি মুখ লুকিয়ে থাকে। বাড়ির গৃহিণীকে রাত জেগে বসে থাকতে হয় কখন গ্যাস আসবে আর কখন সে রাঁধতে পারবে এই আশায়। পানিরও সেই একই হাল! যারা বস্তিবাসী বা নিম্নবিত্ত মানুষ, তারা তো রাস্তায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে পানির জন্য। যাদের নিজস্ব ট্যাংক আর মোটর আছে, তাদেরও পানি আসার অপেক্ষায় অনেক সময় রাত জাগতে হয়। ওয়াসার সঙ্গে যাদের সরাসরি লাইন তাদেরও নিস্তার নেই। মাঝে মাঝেই পানি আট-দশ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। কখনো মাইকিং করা হয়, কখনো হয় না।

রাস্তা খোঁড়া, মশা, মাছি, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সমস্যা এসব যাতনা নিয়ে থাকি, আক্ষেপ করি, তারপরও ঢাকাকে ভালোবাসি, এটাই বাস্তবতা। ঢাকা ছেড়ে কোথাও গেলে দুদিনেই হাঁফিয়ে উঠি। বিদেশের নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবনে মন টেকে না। দেশে ফেরার জন্য পাগল হয়ে উঠি। একেই বোধহয় বলে মাটির টান। কষ্ট করি আর ভাবি, কবে দেশটা ভালো হবে, ঢাকা বাসযোগ্য হবে। হলো না। বসবাসের জন্য সবচেয়ে খারাপ শহরের তালিকায় আবারো স্থান হলো ঢাকার। তাও যে-সে স্থান নয়, দ্বিতীয় স্থান। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান— ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এই তালিকা প্রকাশ করেছে। সিরিয়ার দামেস্কের পরের অবস্থানেই রয়েছে ঢাকা। গত বছরও ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। এবারো ঢাকার পাওয়া নম্বরের কোনো পরিবর্তন হয়নি।  দামেস্ক গত বছরের চেয়ে কম নম্বর পেয়েছে।

বিশ্বের ১৪০টি শহরের ওপর জরিপ করে প্রতি বছর ‘বৈশ্বিক বসবাস উপযোগিতা সূচক’ প্রকাশ করে ইআইইউ। অপরাধের মাত্রা, সংঘাতের ঝুঁকি, স্বাস্থ্যসেবার মান, বাধা-নিষেধের মাত্রা, তাপমাত্রা, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বসবাসের উপযোগী শহরের ওই তালিকা করা হয়। এবার বসবাসের জন্য সবচেয়ে ভালো শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ‘ভিয়েনা’। গত বছর এই স্থানে ছিল অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। তখন মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে মেলবোর্নের নম্বর ৯৭.৫। ভিয়েনা এবার মেলবোর্নকে হারিয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করেছে। প্রথমবারের মতো ইউরোপের কোনো শহর ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের বার্ষিক জরিপে শীর্ষস্থান অর্জন করল। ২০১৮ সালে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় থাকা বাসযোগ্যতার দিক থেকে ভিয়েনার পরই রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, জাপানের ওসাকা, কানাডার ক্যালগেরি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, জাপানের টোকিও, কানাডার টরন্টো, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ও অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড।

অন্যদিকে বাস অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ার দামেস্ক। তালিকার তলার দিক থেকে বিবেচনা করলে দামেস্কের পর রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, নাইজেরিয়ার লাগোস, পাকিস্তানের করাচি ও পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসবাই। ইকোনমিস্ট বলছে, বাস অযোগ্য শহরের র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে অপরাধ, নাগরিক অশান্তি, সন্ত্রাস অথবা যুদ্ধ ‘শক্তিশালী ভূমিকা’ পালন করেছে।

সিরিয়া রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট এবং বাথ পার্টির হাতে ন্যস্ত।  সংবিধান মতে, সিরিয়া একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র হলেও ১৯৬৩ সালে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে এবং বর্তমানে সরকার পরিবর্তনের কোনো ক্ষমতা নেই জনগণের। দেশটি তাই কার্যত একটি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সিরিয়ার সরকার ইসরাইলের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধকে জরুরি অবস্থার মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সিরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদ পাঁচবার গণভোটে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। তার ছেলে ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদও ২০০০ সালের গণভোটে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে বহাল হন। প্রেসিডেন্ট ও তার মূল সহযোগীরা, সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা সিরিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতির মূল সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকেন। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ২০১০ সালে শুরু হয়। ২০১১ সালের জুলাই সেনাবাহিনীর দলত্যাগীরা ফ্রি সিরিয়ান সেনা গঠনের ঘোষণা দেন এবং যুদ্ধ ইউনিট গঠন শুরু হয়।

গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০১৬-তে বিশ্বের সবচেয়ে অশান্ত দেশ ছিল সিরিয়া। কয়েক বছর ধরে সিরিয়ায় তাণ্ডব চালাচ্ছে আইএস জঙ্গিরা। এ কারণে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে বা আইএসবিরোধী অভিযানে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও বেশ উদ্বেগজনক। কাজেই বসবাস অযোগ্য দেশ হিসেবে নিচে থাকা সিরিয়ার জন্য বিস্ময়কর কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশ তো একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ নেই। দীর্ঘদিন ধরে একটি সরকার দেশ পরিচালনা করছে। দৃশ্যত অনেক উন্নয়নই আমরা দেখছি দেশটির। একের পর এক উড়াল সেতু হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে, নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও কেন এই অবস্থা!

ইআইইউর সূচক তৈরিতে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ২৫ নম্বর বরাদ্দ রাখা হয় স্থিতিশীলতার জন্য। ২০ নম্বর স্বাস্থ্যসেবার জন্য। এ ছাড়া সংস্কৃতি ও পরিবেশের জন্য ২৫ নম্বর, শিক্ষার জন্য ১০ এবং অবকাঠামোর জন্য ২০ নম্বর ধরে তালিকা করা হয়। মোটা দাগের এসব ক্যাটাগরির ভেতরে অবশ্য আরো অনেক সাব-ক্যাটাগরি থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের মতো স্থিতিশীলতার বড় সঙ্কট না থাকলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অবকাঠামোর দিক দিয়ে ঢাকা অনেক পিছিয়ে আছে। ঢাকার রাস্তার পাশে পাশে অগুনতি বস্তি, টোকাই, ভিখিরি, ময়লা উপচানো ডাস্টবিন হা করে থাকে। এই মানুষগুলোর শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই, বাসস্থান নেই। এরা জলে ভেজে, রোদে পোড়ে। আর শিক্ষা স্বাস্থ্য না থাকলে সংস্কৃতি বিকাশের তো কোনো সম্ভাবনাই নেই।

আমরা বলি শিক্ষিত হচ্ছি। আসলে কি হচ্ছি? শহরজুড়ে কোচিং ব্যবসা জমজমাট। এক একটা ছাত্র আট-দশটা টিচারের পেছনে ছুটছে। কেউ কেউ স্কুল বন্ধ করে দিয়ে কোচিংই করছে। শিক্ষকরা এখন অনেক বড়লোক। আগে ছাত্ররা ইংরেজি, অঙ্ক পড়ত; এখন বাংলা থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ই পড়তে হয়। অথচ পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে তারা কিছুই জানে না। শিক্ষকরা নোট দেন, সেটাই মুখস্থ করে। এতেই বোঝা যায় শিক্ষার মান কতটা বেড়েছে! আর প্রশ্নফাঁস তো নিত্যকার ঘটনা। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও অরাজকতা। ডাক্তারের কাছে গেলেই একগাদা টেস্টের মধ্যে পড়তে হবে। তাও আবার করাতে হবে ডাক্তারের পছন্দমতো জায়গা থেকে। সর্বত্র কমিশন বাণিজ্য। কী ডাক্তার, কী নার্স কারোরই নেই সেবার মানসিকতা।

ঢাকার নদীগুলো মরে গেছে। আবর্জনা দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে বুড়িগঙ্গার মতো নদীও, খাল পুকুর ডোবা নেই বললেই চলে, ড্রেনেজ সিস্টেম ভয়াবহ, নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছ। অপরাধ সন্ত্রাস সীমাহীন। ছিনতাই রাহাজানি হত্যা ধর্ষণ বেড়েই চলেছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। আছে প্রতিকারহীনতা। এগুলোর কোনো উন্নতি হচ্ছে না বলেই বাজে শহরের তালিকায় ঢাকা প্রতি বছর খারাপ অবস্থানে থাকছে। এ নিয়ে তিন বছর ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থান পেল।

এ বছর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ঢাকা কত নম্বর পেয়েছে তা জানা যায়নি। তবে গত বছর স্থিতিশীলতার দিক দিয়ে ১০০’র মধ্যে ঢাকার নম্বর ছিল ৫০। আর দামেস্কের নম্বর ছিল ১৫। অন্য তিন বিষয়ের দুটিতে দামেস্ক এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে। এমনকি স্থিতিশীলতার দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোর দিক দিয়ে পাকিস্তানের করাচি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। বসবাসের যোগ্যতায় সবচেয়ে উন্নতি করেছে জিম্বাবুয়ের হারারে। এ ছাড়া নেপালের কাঠমান্ডু, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, চীনের পেইচিং, আজারবাইজানের বাকু ও কেনিয়ার নাইরোবিও আছে উন্নতির সেরা দশের তালিকায়। অবনতির দিক দিয়ে প্রথমেই আছে সিরিয়ার দামেস্ক। এর পরের অবস্থানে ইউক্রেনের কিয়েভ, লিবিয়ার ত্রিপোলি, তিউনিসিয়ার তিউনিসসহ কয়েকটি শহর।

একটি শহরের অবকাঠামো-উপরিকাঠামো এবং মানবিক কাঠামো তিনটিরই যদি একসঙ্গে উন্নতি হয়, সেটাই হয় উন্নত দেশ, বসবাসযোগ্য দেশ। অন্তঃসারশূন্য কিছু বাহ্যিক উন্নতি দিয়ে বসবাসযোগ্যতা পরিমাপ করা যায় না। ভালো থাকার সূচকগুলো পূরণ করে সমাজের সব শ্রেণির মিলিতভাবে ভালো বসবাস করাই ভালো থাকা। প্রয়োজনীয় সম-উন্নয়ন, সম-সুযোগ এবং সম-বণ্টন ভালো থাকা, ভালো বসবাসের অন্যতম শর্ত।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads