• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ভিন্নমত

বিশ্বনাগরিক তৈরির জন্য বিদ্যালয়

  • রীমা আক্তার
  • প্রকাশিত ০৬ অক্টোবর ২০১৮

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আগামী দিনের নেতৃত্ব অর্জন করতে চাই বিশ্বনাগরিক হওয়ার যোগ্যতা।’ বিশ্বনাগরিক (Global Citizen) কথাটি অতিসাম্প্রতিক হলেও এর ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস নিজের পরিচয় দিতেন এভাবে, ‘আমি গ্রিকের নই, আমি এথেন্সের নই; বরং আমি সারা বিশ্বের নাগরিক।’ ইংরেজ ও আমেরিকান রাজনৈতিক কর্মী, দার্শনিক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক টমাস পেইন বলেন, ‘সারা বিশ্বই আমার দেশ, প্রতিটি মানবই আমার ভাই।’ আধুনিক যুগে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান, সাবেক সফটওয়্যার নির্মাতা বিল গেটস তার বক্তব্যে বলেন, ‘I think of myself as a global citizen.’ উইকিপিডিয়ার মতে, বিশ্বনাগরিক হলো এমন এক মানবদর্শন যেখানে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানা পেরিয়ে একপরিচয়ে বেড়ে উঠতে পারে। উত্তর-আধুনিক একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বিশ্বনাগরিক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বনাগরিক হওয়ার মধ্য দিয়ে একজন নাগরিক বিশ্বনেতৃত্ব ও কর্তব্য পালনের যোগ্যতা অর্জন করে। বিশ্বনাগরিক তৈরির জন্য বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

শিক্ষায় বিশ্বনাগরিক বা বিশ্বনাগরিক হওয়ার শিক্ষা একটি অতিসাম্প্রতিক ইস্যু। দৃশ্যত বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রসারিত হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। নিত্যনতুন তৈরি হচ্ছে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাসের হার। এদেশে নারীশিক্ষার হারও এশিয়া মহাদেশে অনুকরণীয়। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কতটুকু বিশ্বনাগরিক তৈরিতে সক্ষম। তৃণমূল পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক ও শিক্ষার্থী মহলে শিক্ষার লক্ষ্য জিপিএ-৫ নামক সোনার হরিণে বন্দি। বিদ্যালয়গুলোও পাল্লা দিয়ে ক্যানভাসিং করছে জিপিএ-৫ এর ফিরিস্তি। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবকও প্রশ্ন ফাঁস বা অসদুপায়ের পেছনে ছুটতে কুণ্ঠাবোধ করছেন না। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে একদিকে যেমন রয়েছে প্রশাসনিক জটিলতা, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে প্রচলিত শিক্ষা কারিকুলামের সীমাবদ্ধতা। ফলে বিশ্বনাগরিক তৈরির স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাচ্ছে।

উইকিপিডিয়ার মতে, বিশ্বনাগরিক শিক্ষা হলো এমন এক নাগরিকবোধ যাতে বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়োজিত করে বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা পরিবেশবিষয়ক কার্যক্রমে। বিশ্বনাগরিক শিক্ষাকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়— বিশ্বসচেতনতা (Global consciousness) এবং বিশ্বদক্ষতা (Global competence)। বিশ্বদক্ষতার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ব উন্নয়নে নিজেকে যোগ্য করে এবং ভূমিকা রাখে। বিশ্বনাগরিক তৈরিতে বিদ্যালয়গুলোকে রাখতে হবে কার্যকর ভূমিকা, শুধু জিপিএ-৫ তৈরির কারখানা নয়, ভূমিকা রাখতে হবে বিশ্বভ্রাতৃত্বে, বিশ্বদর্শনে, বিশ্বসম্প্রতি তৈরিতে। বাড়াতে হবে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি, শেখাতে হবে সহনশীলতা। পাশাপাশি বাড়াতে হবে দক্ষতা। বিশ্বদক্ষতা তৈরির বীজ বপন করতে হবে শিক্ষার্থীদের জীবনের শুরু থেকেই। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ্যা ও ভাষাগত দক্ষতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির এই যুগে বিদ্যালয়ের পাঠদানে প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। সরকারি পর্যায় থেকে বিদ্যালয়গুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের প্রশিক্ষণ ও গুরুত্ব দেওয়া হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ অপ্রতুল। বিশ্বনাগরিক তৈরির প্রধান কারিগর হলো বিশ্বনাগরিক বোধসম্পন্ন দক্ষ শিক্ষক, যারা প্রস্তুত করবে আগামী প্রজন্মকে বিশ্বনাগরিকবোধ ও দক্ষতা তৈরির মাধ্যমে শান্তি ও সহনশীলতার পৃথিবী উপহার দিতে।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শিক্ষার্থীদের বিশ্বনাগরিক ভাবনার সঙ্গে পরিচয় ও সম্পৃক্ত করিয়ে দেওয়া। ইন্টারনেটের সুবাদে হাতের কাছেই এখন গোটা পৃথিবী। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাইলেই পারেন এখন বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতির সঙ্গে নিজেদের পরিচিত করতে, পাশাপাশি আয়োজন করতে পারেন বিভিন্ন ই-কনফারেন্স যাতে করে শিক্ষার্থীরা অবগত হতে পারে বিশ্বের বড় বড় বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে। বিশ্ব সঙ্কট মোকাবেলা, বিশ্ব-অর্থনৈতিক কার্যাবলি, সমতা ও বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব তৈরিতে Global Citizen Education-এর বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা ও প্রযুক্তিজ্ঞান অত্যাবশ্যক। পাঠ্যবই ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের বিশ্বনাগরিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কীভাবে পাঠদান ও কার্যক্রম করানো হচ্ছে, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটে বলেছিলেন, ‘He who knows no foreign language knows nothing of his own.’ বিশ্বনাগরিকবোধ তৈরিতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান অত্যাবশক। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো চাইলেই গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে বিভিন্ন বিদেশি ভাষার পাঠদান ও চর্চায়। বিদেশি ভাষা শিক্ষার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী শৈশবকাল থেকেই বিশ্বনাগরিকবোধ নিয়ে বড় হতে পারে।

প্রাচীন এক আরব প্রবাদের কথা মনে পড়ছে, ‘Learn a language, avoid a war. লেখক, রাজনৈতিক কর্মী, মানবতাবাদী হেলেন কেলার বলেছিলেন, ‘শিক্ষার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হলো সহনশীলতা।’ শিক্ষার্থীদের সহনশীলতা শিক্ষাদানের দায়িত্বও বিদ্যালয়ের। ফরাসি সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকারকর্মী ভিক্টর হুগো বলেন, ‘কেউ বিদ্যালয়ের একটি দরজা খোলা মানেই হলো জেলখানার একটি দরজা বন্ধ করা।’ বিদ্যালয়ের প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই সহনশীল এবং বৈষম্য ও বিদ্বেষমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব। সেই পৃথিবীর প্রতিটি নাগরিক তৈরি হবে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বনাগরিকের পরিচয় নিয়ে বিশ্বায়নের এই পৃথিবীতে।   

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads