• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বিকিকিনির হাটে

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

মানুষ চলেছে একা। জন্ম থেকেই একাকিত্ব তার সারা সঙ্গী। এত কোলাহল, যন্ত্রচালিত যানের দৌরাত্ম্য, শশব্যস্ত মানুষের ছোটাছুটি, হকারের চিৎকার, হাজারো মানুষের শোরগোল— তবু আধুনিক নগরে মানুষ একা, শূন্য! গন্তব্যে পৌঁছুতে পৌঁছুতে মনে হয় আগামীকালের উদিত সূর্যের মধ্য দিয়ে যে সমাজ জেগে উঠবে, তার সঙ্গে একুশ শতকের মানুষের সম্পর্ক কতটুকু? স্বার্থপরতার দলিল লেখা ছাড়া আর কোনো উইল নেই এই জাগতিক সংসারে। অথচ এই বাংলার গ্রামগঞ্জের জীবন ছিল বহতা নদীর মতো। সেই গ্রাম আজ নগরায়নের চাকায় পিষ্ট।

বাংলার গ্রামগুলোতে একসময় সাপ্তাহিক হাট বসতো। অবশ্য এখনো যে নেই তা নয়। সংস্কার হতে হতে সে হাটের খোলনলচে বদলে দিয়েছে আজকের মানুষ। তবে একটা সময় ছিল যখন এই হাটের দিকে তাকিয়ে থাকতো গ্রামবাংলার সহজ-সরল মানুষগুলো। সেই হাট ছিল প্রাণের মেলা। দেখা যেত দুই-তিন গ্রাম মিলে বসতো একটাই হাট। রসনা-ব্যঞ্জনের আনাজপাতি থেকে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি নিয়ে হাটুরেরা আসতো ওই সপ্তাহের হাটগুলোতে। সেই হাটে খেলনাসামগ্রী, নানা রঙের চুড়ি-আলতা-ফিতে, নাগরদোলা, জাদুর বাঁশি, বায়োস্কোপ, মাটির পুতুল সবই পাওয়া যেত। তাই গ্রামবাংলার ওই হাটে ছিল প্রাণের চাঞ্চল্য। শুধু ঘরের পুরুষেরাই সওদা কিনতে আসতো না, সেখানে নরোম পা ফেলে ঘোমটা টেনে ঘরের বধূর সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়েরাও আসতো দল বেঁধে। দু-তিন গ্রামের মানুষ এক হতো এই গ্রামের হাটে, শুধু সওদা বেচাকেনা নয় বরং নিজেদের সুখ-দুঃখও বিকিকিনি হতো এই প্রাণের মেলায়। কখনো বর-কনে দেখা হতো, কথা পাকাপাকি, এমনকি এই হাট থেকে পিতার হাত খসে হারিয়ে যেত অবুঝ সন্তান! কিন্তু এখন এই গ্রামগুলো ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে পৌরসভা। যন্ত্রচালিত যান, বিদ্যুৎ, সুয়ারেজ, পানীয় জল সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে গ্রামের মানুষ। যে দুয়েকটি গ্রাম পৌরসভাকে পাশ কাটিয়ে চলেছে, সেও এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই আজ প্রতিটি গ্রামেই বসে আলাদা আলাদা সাপ্তাহিক হাট। এ হাটে ব্যবসা আছে, প্রাণ নেই। এ হাট থেকে খেলনাসামগ্রী, বায়োস্কোপ, মাটির পুতুল সব উধাও। এখানে এখন আর দু-তিন গ্রামের মানুষের মনের মিলন নেই। মন দেওয়া-নেওয়া হয় না আর, সুখ-দুঃখ পাশাপাশি হেঁটে যায়, কেউ কারো ছায়া দেখে না। ‘অমল রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’— জীবনের ওপর সেই রোদ কেমন ফিকে হয়ে আসে!

এই বিকিকিনির হাট এখন ‘শপিং মল’-এ রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্নয়নের ছোঁয়া এসে লেগেছে এই বাংলার গ্রামগুলোতেও। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। এর মানুষগুলোর শরীরেও লেগেছে নগরায়নের হাওয়া। নাগরিক বিলাস আজ গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোর জীবনকে করে তুলেছে বেপরোয়া, অহেতুক প্রতিযোগিতা। তাই আজ গ্রাম নামক উপ-শহরগুলোতেও গড়ে ওঠে ‘বিপণি বিতান’। মানুষ ভিড় করে। প্রাণ-গন্ধ-স্বাদহীন প্যাকেটজাত দ্রব্য করুণ আভিজাত্যে কিনে নেয় সব। কী নেই এখানে? আনাজপাতি, শুকনো খাদ্যদ্রব্য, জামাকাপড়, এমনকি টয়লেট্রিজ থেকে প্রসাধনী। কী চাই আপনার? এখানে শুধু মন নেই, প্রাণের চাঞ্চল্য নেই। আছে অর্থের ঝনঝনানি, কাঁচা টাকার উল্লাস। কৃত্রিম কুশল বিনিময় আর পরশ্রীকাতরতা!

স্বার্থ দিয়ে গড়া এই কৃত্রিম বাজারে বিনোদনের জন্য বাজানো হয় বিজাতীয় সঙ্গীত, বাংলা গানের নামে উদ্ভট চটুল সব গান। খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির মাঝে গ্রামীণ হাটের সেই প্রকৃত সত্য চিরকালীন বিনোদন আজ হারিয়ে গেছে। দিনযাপনের কড়চায় হিশেবের খাতায় বার বার ভুল হয়ে যায়। শেষ অঙ্ক মেলে না কারো! বায়োস্কোপের বদলে এখন সিনেপ্লাক্স, ডিজিটাল মুভি— অ্যাকশন, হরর প্রভৃতি। ঘুম থেকে উঠতেই শপিং মলের বিজ্ঞাপন মোবাইল ফোনে এসে যায়। একটি কিনলে একটি ফ্রি, ৫% ছাড়, ৩৫ টাকা অফ— আরো কত কী! কিন্তু গ্রামের হাটের সতেজ দ্রব্যের সেই স্বাদ কোথায় পাওয়া যাবে? তাই তো রোগহীন জীবনের আশায় ছুটে বেড়াতে হয় পার্কের সবুজ লনে, হাসপাতালের করিডোরে, শ্বাসটুকু বন্ধ যাতে না হয় তার জন্যে মুঠোয় ধরে রাখতে হয় সার্বক্ষণিক ইনহিলার। এই হাটে একদিন উঠেছিল শরৎবাবুর ‘মহেশ’? ‘মহানগর’-এ গঞ্জের হাটে প্রেমেন্দ্র মিত্রর মুকুন্দ ভিড়িয়েছিল তার নাও। মানিকের কুবের দক্ষ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ইলিশ তুলেছিল মহাজনের হাটে। সেই হাট এখন মৃত, কোথাওবা জীবন্মৃত। মানুষের ঊর্ধ্বশ্বাসে মরীচিকার পেছনে ছোটার ভেতরে গঞ্জের হাট এখন শপিং মল, বিপণি বিতান, সুপার মার্কেট আরো কত কী নামে অভিহিত হয়! কাঁচাবাজার, মাছ-মাংস, ফলমূল এখন মানুষের দোরগোড়ায় ফেরি হয় জুয়াড়ির পাশা খেলার মতো। বাসি নাকি টাটকা— জানা নেই, ঠকবে নাকি জিতবে— বোঝার উপায় নেই। এখন গ্রামবাংলার হাট থেকে গঞ্জের হাট, সেখান থেকে মহানগরের শপিং মল— সবখানে দেখি একই স্বর, একই সুর, একই লয়। কোন্্খানে বাঁধবে তুমি প্রীতির বন্ধন? নরেন্দ্রনাথ মিত্র যে ‘রস’ তুলেছিলেন একদিন এই বাংলার হাটবাজারে, সেই মায়াময় রসের সুধা এখন আর পাওয়া যায় না! তাই ভুলচুক নগরের জাঁকালো পিঠা উৎসবে নগর-মানুষ ছোটে কৃত্রিম বাঙালি সেজে।

মনের আরশিতে বন্দিদশা মানুষের শেকলের ঝনঝনানি শোনা যায়। সমৃদ্ধশালী নগরের কাছে জ্বরা, তাপ, উল্লাস আর অহংকারের আধুনিকতা ছায়া ফেলে। আধুনিক জীবনের বিষফল, কাঁটাগুল্ম যে স্বাক্ষর রেখেছে জীবন-নৌকায়, তারও ছায়া ফেলে এই তথাকথিত নগরায়নের কৃত্রিম সজ্জায়। একটা প্রলয়োল্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান মানুষ নিজেরই প্রতিবিম্বের কাছে। বিপরীতে অসংখ্য প্রতারিত জীবনের ছায়া মেখে নেয় সে নিজের শরীরে। তাই মনের আরশির দরজা খুলে পালাতে চায় এই আধুনিক জীবন। কাঠকয়লার জীবন অবশেষে বাসা বাঁধে কৃত্রিম নগরবিলাসে, জীবনের ভাগাড়ে। বেঁচে থাকাই যেখানে উপলক্ষ। কুলকুচি সারতেই নিজের চোখের সরণিতে দেখা যায় বিশ্বস্ত কিছু দৃশ্য। রহস্যাবৃত কিছু মায়াবী মুখ জীবনানন্দের ট্রামকেই ভালোবেসেছিল যেন। আলট্রাভায়োলেট রশ্মি, সুতোনালী সাপ আর মৎস্যকুমারীর ডুবসাঁতার গেঁথে নেয় যূথবদ্ধ জীবনের কোলাজ। ওই মুখ দেখতে গিয়ে ‘স্বচ্ছ জলের নীচে আবিষ্কার হলো পরস্পরের প্রতি অপরিসীম ঘৃণা আর বিদ্বেষ’। মানুষেরই তৈরি নগরায়নের পথে কার্বন ডাই-অক্সাইড। সেই বিষবাষ্পে আজকের বাজারের পটভূমিতে জেগে ওঠে যন্ত্রের নির্ঘোষ ছটফটানি, ঊর্ধ্বমুখ শিল্পবিতান— ওই কলের শঙ্খনাদ, সুউচ্চ মিনার অভ্রভেদী প্রাসাদ শিখরে— এসব কিছু মানবাত্মাকে করেছে ভঙ্গুর। এই যাত্রাপথে যে আলোকোজ্জ্বল শিল্পের সম্ভার— সেখানে ‘অপূর্ণ মানুষ’ খেলা করে, জানে না কোন্্ উৎসাহে। কঠিন ধাতু আর ইটের ফ্রেমে বন্দি এই জীবন নাগরিকতাকে ছুঁতে গিয়ে হারিয়ে বসে আছে মন, মনের শিলালিপি। নাগরিক যন্ত্রণায় সে বুনে চলেছে বাংলার হারিয়ে যাওয়া আকাশ, নক্ষত্র, কাশবন, দূর্বাঘাস, গঞ্জের ফেরিঅলা। মসৃণ জীবনের সুতো ছিঁড়ে গেছে— নিশ্চিহ্ন সেই মা-মাটির পথ, তার নিশানা। জীবনকে সাজাতে গিয়ে জীবনের ভাগাড়ে এ কোন্্ উপভোগ? জীবন নিজেই আজ বিক্রি হয়ে বসে আছে বিকিকিনির হাটে। এ যেন এক বিশাল দুর্বোধ চিত্রের অনূদিত সঙ্গীত!  মানুষের বোধ ও বোধির আঙিনায় জীবনের বিচিত্র রঙ। রঙের আল্পনায় ধরা পড়ে সময়ের ডানা। প্রকৃতির মতো বহু রঙে জীবনের পথ হাঁটা, গন্তব্যকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা মানুষের, কালের শুদ্ধ শরীরে। মন থাকে জ্যোৎস্না রঙের মতো দুধশাদা। মুক্ত পাখির মতো অসীম প্রকৃতির মাঝে বিচরণের ইচ্ছা। বিশ্বময় বৈচিত্র্যপূর্ণ চলার বাসনা। অসম্ভব সুন্দরের আকাঙ্ক্ষায় পলকহীন বর্ণিল চোখে আগামীর পথে হাঁটা। অথচ জীবন ও জীবিকার সন্ধানে দুর্বোধ্য নাগরিক জীবনে বিবর্ণ সেই জীবনের রঙ। সময়ের বিবরে তাই কোন্্ মরীচিকার পেছনে ছুটে চলা নগর মানুষের আপন পৃথিবী দোলে?

আজ তাই মহাজাগতিক জীবনে অসম্ভব লাগে এই বিকিকিনির হাট! এ পথ জটিল, সংকীর্ণ— সেখানে দুর্বল মানুষের দিনযাপন যেন ‘ক্রাচের জীবন’! এই সঙ্গীত ভেঙেপড়া জীবনের সুরের বন্যা হয়ে অহোরাত্র জেগে থাকে একুশ শতকের বিকিকিনির হাটে। ক্লান্ত জীবন পা টেনে টেনে চলে— অনির্দিষ্ট আশ্রয়ের খোঁজে। অথচ নগর জীবনে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মানুষ এতই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে যে, মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠায় নিজেদের মধ্যকার ঐক্যও আজ বিনষ্ট। তবু থেমে থাকেনি নগর-মানুষের পথচলা। বায়ুহীন বাষ্পের শেষ সলতেটুকু দিয়ে হলেও অবিরত চলছে মানব-জীবনের চাকা।

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads