• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ভিক্ষাবৃত্তি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা

ভিক্ষা এক প্রাচীন পেশা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ভিক্ষাবৃত্তি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১০ অক্টোবর ২০১৮

আজকাল রাস্তাঘাটে চলা বড় মুশকিলের ব্যাপার। দুই পা যেতে না যেতেই হাত পেতে দাঁড়ায় একজন করে ভিক্ষুক। নানা ধরনের, নানা বয়সের। বেশিরভাগই শক্ত সমর্থ। দিব্যি কাজ করে খেতে পারে কিন্তু করবে না। অফার করে দেখেছি অনেকবার। দৌড়ে পালিয়েছে। অথচ দেশের মানুষ গৃহকর্মীর অভাবে উচাটন। অনেক চাকরিজীবী গৃহিণী গৃহকর্মী না পাওয়ায় সন্তানদের নিয়ে অসহায় দিনযাপন করছেন। দেশে এখনো ভালো ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে ওঠেনি। মানুষ চায় বেশি বেতন দিয়ে হলেও গৃহকর্মী রাখতে। কিন্তু সমর্থ নারী ভিক্ষুকরা রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে রোদে জ্বলে, পুরুষরা শক্তি থাকা সত্ত্বেও কাজ করবে না। ঘরে-বাইরে, মেসে, বাস-ট্রেনে, লঞ্চ-স্টিমারে, অফিস-আদালতে, কল-কারখানায়, খানকা-মাজারে, মসজিদ-মন্দিরে ভিক্ষুকের ছড়াছড়ি। বাসস্ট্যান্ডে বা রেলস্টেশনে দাঁড়ালেই মুখোমুখি হবেন হরেক কিসিমের ভিখারির। সিটে বসে স্বস্তি পাবেন না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঘ্যান ঘ্যান করেই চলেছে। ওদের অবিরাম বিলাপে অস্থির হয়ে উঠবেন আপনি। কিছু ভিক্ষুক কর্কশকণ্ঠে চেঁচিয়ে কান ঝালাপালা করে ছাড়বে। অনেকে আবার দরদ ভরে কোরাসকণ্ঠে জারি গেয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। শুধু কি তা-ই! আপনি হয়তো কোনো ঝামেলা বা দুশ্চিন্তায় আছেন, সমাধান বা পরামর্শের জন্য কোথাও গেছেন, সেখানেও পৌঁছে যাবেন ভিখারি সাহেব। কিন্তু তাদের কোনো কটু কথা বলা যাবে না। এমনভাবে অভিসম্পাত করবে যে, আপনি চলে ফিরে ঘুমিয়ে শান্তি পাবেন না।

ভিক্ষা এক প্রাচীন পেশা। পৃথিবীর সব দেশেই ভিক্ষুক আছে। কিন্তু এ পেশা বাংলাদেশে এক জটিল এবং জাতীয় সমস্যা। এদেশে ভিক্ষুক সমস্যা দিন দিন যে হারে আশঙ্কাজনক পরিণতির দিকে মোড় নিচ্ছে, জাতি হিসেবে আমাদের কাছে তা সত্যিই লজ্জার। ভিক্ষাবৃত্তি মানে ভিক্ষার মাধ্যমে জীবনধারণ। আর যারা নিজের অক্ষমতা ও অসামর্থ্যের কথা অন্যের কাছে অকপটে বলে সাহায্য নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, তারাই ভিক্ষুক।

আমাদের ছেলেবেলায় বাড়িতে বাড়িতে মুষ্টিচাল রাখার প্রচলন ছিল। এর নেপথ্য কারণ ছিল, যদি কখনো চাল বাড়ন্ত হয় তখন ওই চাল দিয়ে দু-একবেলা চলে যাবে। তখন এখনকার মানুষের মতো হাতে অত পয়সা থাকত না। মুষ্টিচাল রাখার মতো ভিক্ষার চালও রাখা হতো আলাদা করে। ভিক্ষুক আসবে, তাকে ভিক্ষা দিতে হবে- এটাই ছিল তখন রীতি। তখন ভিক্ষাবৃত্তিকে কেউ অত খারাপ চোখেও দেখত না আর বিরক্তও হতো না। কারণ সত্যিই যাদের ভিক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, তারাই ভিক্ষা করত।

ছোটবেলায় দেখতাম, দরজায় ভিক্ষুক এসে বলত- ‘মাগো কয়টা ভিক্ষা দ্যাও, সারাদিন খাই নাই। ভাত থাকলে দ্যাও।’ তখনো হয়তো রান্না হয়নি। সে কথা বলতেই ভিক্ষুক দ্রুত জবাব দিতো, ‘বাসি ভাত-তরকারি থাকলে তা-ই দেন!’ মা আবার বলতেন, ‘তরকারি তো নেই।’ ভিক্ষুক বলত, ‘পেঁয়াজ কাঁচামরিচ নাই? থাকলে তা-ই দেন!’

তখন প্রযুক্তির প্রসার হয়নি। তাই গরিব, অসহায়, সম্বলহীন মানুষদের ভিক্ষা ছাড়া উপায় ছিল না। মানুষ ভিক্ষা দিতেও কার্পণ্য করত না। ভিক্ষুককে ফেরাতো না কেউই। ভিক্ষুক ফিরিয়ে দেওয়া অমঙ্গলজনক মনে করতেন। এখন সকাল থেকে শুরু করে ঘরে ফেরা পর্যন্ত প্রতিদিন কম হলেও অর্ধশত ভিক্ষুক চোখে পড়ে। তাই এখন আর মানুষ ভিক্ষাদানে উৎসাহ পান না। এদেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা কত, এর সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। দেশে বিচিত্র ধরনের ভিক্ষুক দেখা যায়।

১. প্রকৃত ভিক্ষুক : অত্যন্ত অসহায় ভিক্ষুক রয়েছে, যাদের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই অথবা থাকলেও নেয় না। তারা কেউ প্রতিবন্ধী, কেউ বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। এদের অনেকের আবার সন্তান-সন্ততি রয়েছে, যাদের দায়িত্ব তাকে নিতে হয়। তাই পেটের দায়ে বাধ্য হয়েই এরা জীবিকার সহজমাধ্যম হিসেবে ভিক্ষার আশ্রয় নেয়। এই শ্রেণির প্রতি অনেকেই সহানুভূতিশীল থাকে বলে এরা ভিক্ষা পায়। সমাজ বা রাষ্ট্র যেহেতু এদের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে না, তাই এদেরও দোষ দেওয়া যায় না।

২. কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট ভিক্ষুক : বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক কারণেও বিপুলসংখ্যক মানুষ নিরুপায় হয়ে ভিক্ষার পথ বেছে নেয়। এরা মূলত কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট ভিক্ষুক। একধরনের স্বার্থান্বেষী মানুষের অযোগ্যতা এবং দুর্নীতির দরুন সাধারণ জনগণ দিন দিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে এ দেশ থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। এদেশে রয়েছে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী। রয়েছে উর্বর ভূমি, কৃষি উপযোগী আবহাওয়া ও দক্ষ-কর্মক্ষম বিপুল মানবসম্পদ। তা সত্ত্বেও নতুন নতুন কলকারখানা সেভাবে স্থাপন হয়নি। বরং স্বাধীনতার পর পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত বহু শিল্পকারখানাও দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অযোগ্যতার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বেকারত্বের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে। তা ছাড়া লাগাতার লুটপাট, দুর্নীতি, অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ অপব্যয় করে দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ফলে জ্যামিতিক হারেই বেড়েছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। অপরদিকে নিত্যনতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছরই অসংখ্য পরিবারকে করে ভিটেমাটিহীন ও নিঃস্ব। অসহায় পরিজনদের জীবন রক্ষার্থে স্বভাবতই এদের এক বিরাট অংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে না নেমে পারে না।

৩. এককালীন/মৌসুমি ভিক্ষুক : আরেক ধরনের মানুষ আছে, যারা প্রকৃত পেশাজীবী ভিক্ষুক নয় তবে অভাবী। তারা জীবিকার তাগিদে যে কোনো ধরনের কাজ করার চেষ্টা করে থাকে। এরা অতিকষ্টে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেলেও সহজে ভিক্ষায় নামে না। কিন্তু কঠিন বিপদে পড়ে বা বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজনে এরাও এককালীন বা সিজনাল ভিক্ষুক সেজে ঈদ, জাকাত মৌসুম, বড় বড় পর্ব উপলক্ষে ভিক্ষায় নামে।

৪. উত্তরাধিকারী ভিক্ষুক : একশ্রেণির ভিক্ষুক আছে, যারা উত্তরাধিকারসূত্রে ভিক্ষাবৃত্তিকে বেছে নেয়। ভিক্ষুক পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজনদের সংস্পর্শে কিংবা দেখাদেখিতে ভিক্ষাকে পেশা বানায়। ভিক্ষাবৃত্তির পরিবেশে ছোট থেকে বড় হয়ে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকলেও এরা অন্য পেশা গ্রহণ করে না।

৫ অভাবী কর্মবিমুখ ভিক্ষুক : অনেক অভাবী কর্মবিমুখ ও অলস মানুষ বিনাপুঁজির মাধ্যম হিসেবে ভিক্ষার পেশাকেই বেছে নেয়। উপার্জনের ঝুঁকিকে ভয় পায় বলেই কর্মক্ষম হয়েও এরা চায় বসে বসে খেতে। তাই গ্রহণ করে চেষ্টা-তদবিরবিহীন এই পেশার অমৃতস্বাদ! কোনো কাজ করতে বললে বা দিতে চাইলেও এরা কাঁচুমাচু করে এড়িয়ে যায়। জোর করে এদের কাজে নিয়োগ করতে চাইলে এরা আদৌ করতে চায় না। বরং আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ভিক্ষা করে বেড়াতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এমনকি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে কাজে লাগানোর পরও এরা পালিয়ে যায়।

৬. ব্যবসায়ী ভিক্ষুক : একধরনের ভিক্ষুক আছে, যারা মূলত প্রতারকরূপী ব্যবসায়ী। বিকলাঙ্গ শিশু, প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ, মৃত কাউকে মাধ্যম বানিয়ে ভিক্ষা করে এরা। অনেকে নিজে অন্ধ, বোবা, কালা, মৃগী রোগী, পাগল সেজে ধোঁকা দিয়ে দিব্যি উপার্জন করে যাচ্ছে। শিশু পাচারকারী, শিশু অপহরণকারী বা ছেলেধরারা গোপন আস্তানায় রেখে কৃত্রিমভাবে বিকলাঙ্গ, কুঁজো বা প্রতিবন্ধী ইত্যাদি বানিয়েও হতভাগ্য শিশুদের ভিক্ষার কাজে ভাড়া খাটিয়ে থাকে। শরীরের দগদগে ঘা জিইয়ে রেখে, রোগী সাজিয়ে বা মৃত আত্মীয়-স্বজনের লাশের সৎকার, শ্রাদ্ধ, কারো বিয়ে, পবিত্র কোরআন কেনা বা খতম দেওয়া, ক্লাসের নতুন বই কেনা, মাদরাসা-মসজিদ, খানকা, পীরের শিরনির নামেও অনেকে চাঁদার নামে ভিক্ষা করে বেড়ায়। এদের অনেকের বাড়ি-গাড়ি আছে। এদের খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায়ও সংবাদ আকারে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।

তবে প্রথমোক্ত তিন ধরনের ভিক্ষুক ছাড়া বাকি সবাই পেশাজীবী বা ব্যবসায়ী ভিক্ষুক। এরা সারা দেশে যে হারে পঙ্গপালের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে আগত বিদেশিদের কাছেও দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বাংলাদেশে এমনও ভিক্ষুক নেতা বা সর্দার আছেন, যার অধীনে ১০-২০ জন ভিক্ষুক একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ভিক্ষা করে। সারাদিন ভিক্ষা করে যা পায়, তার সিংহভাগ নিয়ে যায় নেতারা আর যৎসামান্য পায় ভিক্ষুকরা। এতে করে তারা খুব সহজে মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করছে বিনা পরিশ্রমে। সমাজের অসহায় শ্রেণিগুলোর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে একশ্রেণির দালাল মোটা অঙ্কের অর্থ রোজগার করছে। হিজড়া না হয়েও অনেক লোক হিজড়াদের নেতা বনে গেছে। তারা হিজড়াদের নিয়ে রীতিমতো ব্যবসা করছে। আগে হিজড়ারা পেটের দায়ে নাচ-গান বা অন্যান্য বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড করে জীবন অতিবাহিত করত। অথচ আজ এসব নকল হিজড়ার প্ররোচনায় তারা এখন রীতিমতো চাঁদাবাজি বা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।

শুধু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, যে কোনো  অসামাজিক বৃত্তি বা সামাজিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানে প্রথমত দরকার সরকারি ও বিরোধী দলের সদিচ্ছা এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এ ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সর্বদলীয় সমঝোতা এবং সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিওদের কার্যকর ইতিবাচক ভূমিকাও জরুরি। তা ছাড়া দেশের হাজার হাজার একর পতিত জমি এবং সরকারের খাসজমি উদ্ধার করে ভিক্ষুকের শ্রেণিভেদে তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বাসস্থান তৈরি, ঋণদানসহ নানারকম কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। এর ফলে সমাজের চিহ্নিত সৎ মানুষদের দায়িত্ব দুর্নীতি, অর্থ তসরুপ ইত্যাদির সুযোগ তেমন থাকবে না এবং জনসাধারণও উপকৃত হবে।

এই অভিশপ্ত পেশার রাহুগ্রাস থেকে সমাজকে মুক্তি দিতে এসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্তির সবচেয়ে ধন্বন্তরি উপায় ভিক্ষুককে কর্মক্ষম করা এবং তার নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা করা। সেটি নিশ্চিত না করতে পারলে যত প্রকল্প আর যত গোলটেবিল বৈঠক, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করি না কেন এবং যত ফরমায়েশি পরিকল্পনাই করা হোক না কেন, কাজের কাজ কিছুই হবে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম-সচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads