• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
গণপরিবহন : নারীর যত বিড়ম্বনা

গণপরিবহন যেন নারীবান্ধব হয়

সংগৃহীত ছবি

মতামত

গণপরিবহন : নারীর যত বিড়ম্বনা

  • প্রকাশিত ১৬ অক্টোবর ২০১৮

ড. শিল্পী ভদ্র

‘বাসায় রান্নাঘরের চুলার গরম, আর বাসেও ইঞ্জিনের ওপর তপ্ত আসন।’ ‘এভাবে যুদ্ধ করে বাসে চড়তে গিয়ে প্রায়ই অস্বস্তি লাগে, হয়রানিরও শিকার হতে হয়। কাউকে বলাও যায় না। মেনে নেওয়াও কঠিন।’ ‘বাসে উঠতে গেলে বলে সিট নাই জোর করে উঠে দেখি, মহিলা সিটে সব পুরুষযাত্রী।’ ‘বাস পুরো থামার আগেই হেলপার আমাকে ঠেলে নামিয়ে দিল।’

উপরের বক্তব্যগুলো আর কিছুই নয়, গণপরিবহনে ভ্রমণ করা নারীদের মোটামুটি একটা অবস্থা। ঢাকা শহরে বাসে-মিনিবাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকার পরও তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন কেবল সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে। অথচ ২০০৮ সালেই ঢাকার বড় বাসে ৯টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণের শর্ত দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পরিবহন কমিটি (ঢাকা মেট্রো আরটিসি)। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭’ খসড়ার নীতিগত অনুমোদনও দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আইনে মহিলা, শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসলে বা বসার অনুমতি দিলে সর্বোচ্চ এক মাসের জেল বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, আর রুট পারমিটে শর্ত হিসেবে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখতে বলা হয়েছে চালকের পেছনে। রুট পারমিটের শর্ত ভাঙলে চলাচলের অনুমতি বাতিল করার এখতিয়ারও আছে পরিবহন কমিটির। এত কিছুর পরও গণপরিবহনে নারীদের হয়রানি সীমাহীন। 

যাত্রীদের অধিকার সংরক্ষণে সরকার যে আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসাযোগ্য। দ্রুত এ আইনের বাস্তবায়ন হলে নারীরা নিরাপদে চলাচলের সুযোগ পাবেন। ডিএমপি অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। অভিযোগ ব্যতীত কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা সে অভিযোগও করেন না।

নারীদের জন্য ঢাকায় বিআরটিসির ১২টি বিশেষ বাস ‘বিআরটিসি মহিলা সার্ভিস’ পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম চালু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সালে তা ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়। ২০০৯ সালে আবার এই সেবাকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।

ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের গবেষণায় দেখা গেছে, নিরাপত্তার অভাব, আর্থিক অসচ্ছলতা ও পরিবহন স্বল্পতার কারণে বেশিরভাগ নারী-পোশাককর্মী হেঁটে কর্মস্থলে যাতায়াত করেন। আবার গণপরিবহনে বিরূপ পরিস্থিতির কারণেও বাধ্য হয়ে বিকল্প বাহনে যাতায়াত করেন অনেক নারী। এতে তাদের আয়ের একটা বড় অংশই চলে যায় পথ খরচায়।

আবার দেখা যায়, নারীরা দিনদুপুরে কিংবা রাতবিরেতে গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়েও নানাভাবে লাঞ্ছিত হন। অ্যাকশন এইডের একটি জরিপে দেখা গেছে, গণপরিবহনে ৪২ শতাংশ নারীযাত্রী পুরুষযাত্রীদের মাধ্যমে এবং পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে ৫৩ শতাংশ নারীযাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, গত ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পর্যালোচনা অনুযায়ী সংগঠনটির তৈরি করা প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, গণপরিবহনের চালক-হেলপারসহ সহযোগীরা মিলে ৯টি গণধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটিয়েছে। 

এসব ঘটনায় মোট ৫৫ আসামিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে, তার প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ ও সংবাদপত্রের অভাবনীয় তৎপরতা লক্ষ করা গেছে। গণপরিবহনে নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন এবং নির্যাতিত হওয়া রোধে পুরুষ যাত্রীদের সহযোগিতার হাত বাড়ানো প্রয়োজন। অনিয়ম ও হয়রানির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট কাজ করলেও জনসচেতনতা বৃদ্ধি এ সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। পরিবহনে অব্যবস্থার কারণে দেশের অনেক নারী ঘরে বসে থাকেন। তারা গণপরিবহনে হয়রানিকে ভয় পান, আতঙ্কে থাকেন।

লেখক খন্দকার মুনতাসির মামুন মনে করেন, ডিজিটাল যুগে নারীদের ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। গণপরিবহনে হয়রানির বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সহযাত্রী দ্বারা লাঞ্ছনার শিকার হলে অন্য যাত্রীরা সহযোগিতার হাত বাড়ালেই নারীদের চলাচলে বিঘ্ন হ্রাস পাবে।

গণপরিবহনে নারীদের ওপর এমন যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন রোধে এবং নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃশ্যমান তৎপরতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নারীদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। তাই সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি বেসরকারিভাবে এ সমস্যা রোধে এগিয়ে আসতে হবে। বাসে পুরুষের সমান সংখ্যক নারী চলাফেরা করলে প্রথম সিট অথবা বাসের অর্ধেক সিট নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হলে এ সমস্যা কমবে বলে আশা করা যায়। নারী বাসে না উঠলে পুরুষ যাত্রীরা বসবেন, কিন্তু কোনো নারী উঠলেই সিট ছেড়ে দিতে হবে এমন বিধিনিষেধ থাকলে নারীদের হয়রানি কিছুটা কমবে বলে মনে হয়।

আবার, গণপরিবহনে নারী-পুরুষ সমান হলে তখন আর নারীরা কোনো নির্যাতনের শিকার হবে না। ফলে সেক্ষেত্রে আর সংরক্ষিত আসনেরও দরকার হবে না। ব্র্যাকের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইনের মতে, গণপরিবহনে নিপীড়কদের আইনের মুখোমুখি করা ছাড়াও গণপরিবহনের অবকাঠামো উন্নয়ন, আলোর ব্যবস্থা করা, পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ক্যামেরা স্থাপন এবং সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সৃষ্টি করা এ সমস্যা সমাধানের উপায়।

কমপ্লেইন বক্স প্রথা চালু করা যায়, যাতে নারীরা তাদের পরিবহন-বিপত্তি জানাতে পারেন। পরবর্তী সময়ে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই গাড়ির লাইসেন্স বাতিল বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা জরুরি। বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার, ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। রাজধানীতে গণপরিবহনে নারী সিটের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিআরটিসি নারী বাস সার্ভিসের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। শুধু নারীদের জন্য বাসের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না; নারী-যাত্রীদেরও সব বাসে বেশি করে ভ্রমণ করতে হবে। এতে তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হবে। অফিস টাইমের আগে ও পরে গণপরিবহনে সংরক্ষিত নারী-সিটের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় আনা খুব জরুরি। সেই সঙ্গে মহিলা আসন সংরক্ষণের আইনটি কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, তা নিয়মিত ফলোআপ করার বিষয়েও জোর দিতে হবে।

গণপরিবহন যেন নারীবান্ধব হয়। আমাদের নারীরা যেন নিরাপদে, আনন্দের সঙ্গে, নিশ্চিন্তে এবং স্বস্তির সঙ্গে গণপরিবহনে যাতায়াত করতে পারেন— এ জন্য সরকার এবং প্রশাসনসহ আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সহযোগিতা এবং উদ্যোগ গ্রহণ করা খুব প্রয়োজন। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সবাই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণপরিবহন নারীদের জন্য নিরাপদ রাখতে এগিয়ে আসবেন, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা খুব বেশি কিছু হবে কি?

(পিআইডির শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ) 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads