• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
নাম ব্যবহার নিয়ে দুটি কথা

প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহারে স্বার্থসিদ্ধি হয়

সংগৃহীত ছবি

মতামত

নাম ব্যবহার নিয়ে দুটি কথা

  • ইউসুফ শরীফ
  • প্রকাশিত ১৯ অক্টোবর ২০১৮

সু আর কু’র দ্বন্দ্ব, ভালো আর মন্দের সংঘাত, কল্যাণ আর অকল্যাণের লড়াই নিয়ে বিশ্বে বহু কথা হয়েছে এবং লেখালেখিও কম হয়নি। এই লড়াইটা আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এ লড়াই করেই মানবজাতি অগ্রসর হচ্ছে, কল্যাণ অস্তিত্বময় থাকছে এবং সভ্যতা হচ্ছে সমৃদ্ধ। আমরাও এ লড়াইয়ের বাইরে নই, এর ভেতরেই ছিলাম, আছি এবং হয়তো থাকবও।

কেউ কোথাও গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে পরিচিত কারো নাম উল্লেখ করতেই পারেন, এটাকে সাধারণভাবে দোষণীয় মনে করার কোনো কারণ দেখা যায় না। কিন্তু যখন নাম ব্যবহারের এই ঘটনা বিশেষ উদ্দেশে ঘটে থাকে, তখন বিষয়টিকে নির্মল বলা যাবে না। সম্প্রতি এরকম একটি ঘটনার কথা শোনা গেছে। একটা সময় এরকম ঘটনা হরদম শোনা গেছে এবং এখনো যে শোনা যায় না, তা বলা যাবে না। প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহারের এ প্রবণতা কেন এবং কী করে শুরু হয়েছে, তা কমবেশি সবারই জানা আছে। 

কারো নামে যদি স্বার্থসিদ্ধি হয়, তাহলে মতলববাজরা সেই নাম ব্যবহার করবে এবং কারো দ্বারা সরাসরি যদি লক্ষ্য হাসিল হয়, তাহলে তারা তাকেই কাজে লাগাবে, এটা খুব স্বাভাবিক তা বলা যাবে না। এই ব্যবহার বা কাজে লাগানোর দ্বারা দুর্জনেরা যা করে, তা হয় চলমান নিয়ম-রীতির ব্যত্যয়, যাকে সাধারণভাবে বলা হয় অনিয়ম এবং যা অবলীলায় দুর্নীতিকে সম্ভব করে তোলে। পৃথিবীতে যুগে যুগে এ প্রবণতা ও তৎপরতা চলে আসছে। আর এটাকে ঠেকাতে সুস্থ চিন্তার বিবেকবান ন্যায়নিষ্ঠ কল্যাণকামী মানুষেরা বিধি-বিধান রচনা করেছেন, সেজন্য উপযুক্ত পদ্ধতি-প্রক্রিয়া বলবৎ করেছেন এবং সেসবের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করার পদক্ষেপও গ্রহণ করেছেন।

প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহারে স্বার্থসিদ্ধি হয়— এটা কমবেশি সব সময়ই লক্ষ করা যায়। নাম তখনই ব্যবহূত হয়, যখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্বার্থসিদ্ধি হয় না। কোনো কোনো প্রভাবশালী লোকের নাম তখন ব্যবহূত হয়, যখন প্রচলিত নিয়ম-নীতি ভেঙে আত্মস্বার্থপর লোকের স্বার্থসিদ্ধির তাগিদ দেখা দেয়। প্রভাবশালীদের নামে স্বার্থসিদ্ধি বা অনিয়ম-দুর্নীতির অশুভ এই প্রবণতার রাশ টেনে ধরে রাখতে হয়। আর এটা সার্বক্ষণিক প্রক্রিয়া। কারণ এই প্রবণতা কখনোই সমাজ থেকে পুরোপুরি নিঃশেষ করা যাবে, এমন মনে করা যাচ্ছে না। প্রত্যেক দেশের মানুষ অন্তত এরকমটাই আশা করেন যে, এই অশুভ প্রবণতা তামাদি হয়ে যাক এবং এটা আশা করাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তাদের আশা কখনো পুরোপুরি পূরণ হয় না। এই না হওয়ার দায়িত্ব কে বা কারা বহন করবেন, জানি না। তবে কারো কারো ভুল চিন্তা, শৈথিল্য বা নেতিবাচক মনোভাব ও তৎপরতা যে নিয়ম-নীতি বা প্রথা-প্রক্রিয়া এড়িয়ে গিয়ে প্রভাবশালী কারো নাম ব্যবহারসহ স্বার্থান্ধ নানা অনিয়মের আবাদ টিকিয়ে রাখে, এতে বোধহয় সন্দেহের বিশেষ কারণ নেই। কীভাবে টিকিয়ে রাখার কাজটা আবধে চলছে, তার বিস্তারিত বিবরণ নিষ্প্রয়োজন। এসবের বিবরণ পত্র-পত্রিকায় অতীতে যথেষ্টই প্রচারিত হয়েছে।

দুই

এক্ষেত্রে হুশিয়ারি উচ্চারণ ও কঠোর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। অতীতে অনেকক্ষেত্রে স্পষ্টতই লক্ষ করা গেছে যে, চাঁদাবাজির পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে, উন্নয়ন কাজে টেন্ডারবাজি ছিল অনিয়ম-দুর্নীতির গেটওয়েস্বরূপ। বিষয়টি আমলে নিয়ে শীর্ষ পর্যায় থেকে তখন হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসবের সঙ্গে যে কেউই জড়িত হোক, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। ক্রান্তি-সময়ে কিংবা কোনো শিথিল মুহূর্তে এরকম প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না, ব্যাপার তা নয়। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলতে হয়, এমনটা ঘটতে পারার সুযোগ থাকতে হবে। সুযোগ থাকলেই, স্বার্থপর বা মতলববাজদের দ্বারা সেই সুযোগ ব্যবহূত হয়। মতলববাজরা সর্বদা শিথিল সময়কে তাদের তৎপরতা চালানোর সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সুযোগ গ্রহণ বা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার পথ বন্ধ করার বিকল্প নেই। তারপরও কথা থেকে যায় এবং সেটা গুরুত্বপূর্ণ কথা। প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহার করা যায় এবং নামে কাজ হয়—চূড়ান্ত বিবেচনায় এর দায়ও কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এড়িয়ে যেতে পারবেন না। কেননা এই প্র্যাকটিস না থাকলে, মতলববাজরা এ কাজ করতে যাবেন কেন এবং সাফল্যের সঙ্গে তা করতে পারবেনই বা কেন? দুর্বল চিত্তের প্রভাবশালী মানুষ সহজে অন্যের দ্বারা নিজেদের নাম ব্যবহারের বিষয়টি অনেক সময় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। আবার এমনও হতে পারে, কোনো দুর্বল মুহূর্তে তারা নিজেরাও প্রভাব ব্যবহার করে ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। এসব কারণেই নিয়ম-প্রক্রিয়ায় এমন কোনো শৈথিল্য রাখা যাবে না, যাতে স্বার্থান্ধ কোনো ব্যক্তি প্রভাবশালীদের কারো নাম ভাঙানোর কাজটি সহজে করতে পারে।

এসব ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক তৎপরতার কোনো বিকল্প নেই বলে এ ব্যাপারে শৈথিল্য উদাসীনতার কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ যে কোনো ক্ষেত্রে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা চূড়ান্ত বিবেচনায় সাফল্যে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। দেশ যখন দ্রুত উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়, তখন সব ধরনের অপপ্রবণতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। বিশেষ করে যখন নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবার জরুরি দায়িত্ব হয়ে পড়ে জাতির কাছে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণের কাজে সরকারকে সার্বিক সহায়তা প্রদান। প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন সময়ও আসে যখন সরকারের সাফল্য হয়ে ওঠে দেশের সাফল্য। ব্যক্তিগত লাভক্ষতির চেয়ে দেশের সাফল্য অনেক বড়।

তিন

প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহারই হোক বা যেভাবেই হোক, অনিয়ম-অপপ্রবণতা প্রসঙ্গে প্রশাসনের কথাও আসে। উন্নয়ন প্রকল্প বা যে কোনো কাজ দেওয়া না দেওয়া ও নজরদারি সবই তাদের কাজ। এক্ষেত্রে দায় এড়ানো সহজ হতে পারে না। প্রশাসন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হলেও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকৃতপক্ষে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী। সরকার যায়, সরকার আসে কিন্তু তারা থাকেন। কাজেই উন্নয়নের পূর্বাপর বিষয় তাদেরই বেশি জানা থাকবে এবং কার্যক্রমের ধারাবাহিকতাও তারাই রক্ষা করবেন। এক্ষেত্রে যে কোনো অনিয়ম-অপপ্রবণতা ঠেকানোর প্রাথমিক দায়িত্বও তাদেরই বহন করতে হয়। অনিয়ম-অপপ্রবণতা বা প্রভাব-প্রতিপত্তি ঠেকানোর জন্য তাদের সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাতে হবে, প্রয়োজনে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তারা সরকারের নির্দেশে চলবেন, সরকারের পরিকল্পনা বা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন, এটা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য, এই বাস্তবায়ন কর্মকে সব ধরনের অনিয়ম-অপপ্রবণতা বা দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখা এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রাথমিক দায়িত্বও তাদের। প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে তাদের এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার সরকারি কর্মকর্তাদের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রশাসনে দলীয়করণের প্রসঙ্গটি মোটেই নতুন নয়। শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে হয় না; বরং প্রশাসনিক দিক থেকেও প্রক্রিয়াটি সমভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে থাকে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্র্যাকটিস থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ প্রতিটি বিবেকবান মানুষ তীব্রভাবে অনুভব করে থাকেন। প্রশাসনে যেসব কর্মকর্তা সত্যিকার দলনিরপেক্ষ, তারাও এ তাগিদ অনুভব করে থাকেন। এ কারণেও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখা দিতে পারে। আর যথাযথভাবে দায়িত্ব পালিত না হলে মতলববাজদের ঠেকানো সহজ হওয়ার কথা নয়।

পরিশেষে নাম ব্যবহার প্রসঙ্গে যে কথাটি বলতে হয়, তা সহজ-সাধারণ কথা হলেও খুব প্রয়োজনীয় কথা। যেখানে বা যার কাছে মতলববাজরা নাম ব্যবহার করেন, সেখানকার দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ বা সেই ব্যক্তি যদি সঙ্গে সঙ্গে যার নাম ব্যবহূত হয়েছে, তাকে জানান, তাহলে বিষয়টির ফয়সালা হয়ে যেতে পারে। কেননা এমনও তো হতে পারে, যার নাম ব্যবহূত হয়েছে, তিনি হয়তো কিছুই জানেন না। যিনি নাম ব্যবহার করেছেন, তাকে হয়তো চেনেনও না। প্রভাবশালীদের নাম ব্যবহারে কাজ হয় বলে এমনটা হওয়া বিচিত্র নয়। কাজেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অত্যন্ত সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রথমত যা হওয়ার তা এমনিই হবে আর যা হওয়ার নয়, তা কোনো প্রভাবশালীর নাম ব্যবহার করেও হবে না। দ্বিতীয়ত, যার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, সরাসরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি অবহিত করা।

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads