• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
ঐক্যফ্রন্টে কতটা লাভ হবে বিএনপির

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ঘোষণার মুহূর্ত

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ঐক্যফ্রন্টে কতটা লাভ হবে বিএনপির

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২০ অক্টোবর ২০১৮

নানা জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে গত ১৩ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করেছে বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে নতুন জোট ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’। তবে এতদিনের পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি এ নয়া জোটের আত্মপ্রকাশে। কেননা, বলা হয়েছিল সরকারবিরোধী একটি বৃহৎ প্ল্যাটফরম হিসেবেই নতুন রাজনৈতিক জোটটি গঠিত হবে। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের অন্যতম উদ্যোক্তা বিকল্পধারা ঐক্যফ্রন্টের বাইরে থেকে গেল। সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়েছে, শর্ত নিয়ে মতৈক্য না হওয়ায় বি. চৌধুরী তার দল বিকল্পধারাকে ঐক্যফ্রন্টে সম্পৃক্ত করেননি। ফলে তাকে বাদ দিয়েই যাত্রা শুরু করেছে নতুন রাজনৈতিক জোটটি।

বি. চৌধুরী তথা বিকল্পধারা শেষ পর্যন্ত ঐক্য প্রক্রিয়ায় থাকবেন কিনা, তা নিয়ে রাজনৈতিক বোদ্ধামহলে সন্দেহ-সংশয় আগে থেকেই ছিল। এ সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব ও বি. চৌধুরী তনয় মাহী চৌধুরীর বিএনপিকে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত শর্তারোপের খবরে। জাতীয় ঐক্য করতে হলে বি. চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টকে দেড়শ’ আসন দিতে হবে এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিতে হবে বলে মাহী দাবি করেছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তখনই গুঞ্জন উঠেছিল, মাহীর এসব দাবি ঐক্য না করার উছিলা মাত্র। ক্ষমতার ভারসাম্য আনার নামে বিএনপিকে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখার পরিকল্পনা থেকেই মাহীর এ দাবি- এমন কথাও বলেছিলেন কেউ কেউ। এ কথার প্রমাণ মিলেছে ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশের দিন পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বি. চৌধুরীর বক্তব্য থেকে। তিনি বলেছেন, জাতীয় ঐক্যের নামে বিএনপিকে এককভাকে ক্ষমতায় বসানোর ‘চক্রান্তে’র সঙ্গে বিকল্পধারা নেই। বি. চৌধুরীর এ বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর সর্বত্র প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে তিনি বা তার দল কী চেয়েছিলেন? তারা কী বিএনপিকে তাদের অনুগামী দলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন?

বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব বিষয়টি বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছেন। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মোহে পড়ে তারা অতীতের কর্মকাণ্ডের জন্য বি. চৌধুরীর কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চেয়ে এসেছেন। বিএনপি নেতৃত্বের এ নতজানু নীতি কর্মীদের মোটেও পছন্দ হয়নি। তারা বলছেন, বিএনপি তো এমন পানিতে পড়ে যায়নি যে, বি. চৌধুরীর কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে! আর সেটা করেও যে কোনো লাভ হয়নি, তা বোঝা গেল ১৩ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে বি. চৌধুরীর বক্তব্য থেকে। বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রশ্ন, বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর ইচ্ছা যদি তার না থাকে, তাহলে কাকে ক্ষমতায় বসাতে চান তিনি? আর ঐক্য প্রক্রিয়াকে যিনি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর ‘চক্রান্ত’ বলেন; তার অন্তরের ভেতরের খবর কী আর চাপা থাকে?

বেশ কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত বিকল্পধারা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সরে যাবে। এ বিষয়ে গত ২ অক্টোবর দৈনিক বাংলাদেশের খবরের এক প্রতিবেদনেও একই কথা বলা হয়েছিল। তা ছাড়া জাতীয় ঐক্য গঠিত হলে এর নেতৃত্ব কে দেবেন তা নিয়ে দুই প্রবীণ নেতার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের খবরও চাপা থাকেনি। ‘এক ঘরমে দো পীর’ অবস্থার কারণে এক পর্যায়ে ঐক্য প্রক্রিয়া ভণ্ডুল হতে যাচ্ছিল বলেও খবর বেরিয়েছিল। সে দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট থেকে বি. চৌধুরীর পিঠটান দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে এখন যে প্রশ্নটি গুরুত্ব পাচ্ছে, সেটা হলো, এতে বিএনপি কতটুকু লাভবান হবে? বলা নিষ্প্রয়োজন, ঐক্যফ্রন্টের অপরাপর অংশীদার দলগুলোর তেমন কোনো প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে নেই। যে নির্বাচনকে সামনে রেখে এ জোট গঠিত হয়েছে, সে নির্বাচনে এসব দল কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ভোটের হিসাব কষলে এসব দলের সমর্থক-ভোটারের সংখ্যা অতি নগণ্য। অথচ আসন বণ্টনের সময় এসব দলের জন্য বিএনপির নিজের ঘরে আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে ভাঙনের সুর বেজে উঠেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে। গত ১৬ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে জোটের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এনডিপি। সংবাদ সম্মেলনে ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি বলেছে, শরিকদের অবমূল্যায়ন, নতুন জোট গঠনের বিষয়ে অন্ধকারে রাখা ইত্যাদি কারণে তারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে থাকাটা আর সমীচীন মনে করছেন না। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, আসলে তারা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। খবরে বলা হয়েছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই বিএনপি ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মতামতের খুব একটা তোয়াক্কা করেনি। এর ফলে জোটের বেশ কয়েকটি শরিক দলের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে। ন্যাপ এবং এনডিপির সঙ্গে আরো ৪-৫টি দলের জোট ত্যাগ করার কথা থাকলেও তারা আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে চায়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন বণ্টন প্রশ্নে সমঝোতা না হলে তারাও জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এলডিপিও জোট ত্যাগ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে এলডিপি ক্ষমতাসীন মহাজোটের ‘মিত্র বৃদ্ধি প্রকল্পে’র আওতায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। একই কথা শোনা যাচ্ছে বিকল্পধারা সম্পর্কেও। গত ১৭ অক্টোবরের কালের কণ্ঠ এক প্রতিবেদনে বলেছে, আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা চেষ্টা করছে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে এলডিপি ও বিকল্পধারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় মহাজোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যদি শেষ পর্যন্ত তা না হয়, তাহলে নির্বাচনী সমঝোতা হবে। কর্নেল (অব.) অলি তিনটি আসন চান আর বি. চৌধুরী তার ছেলে মাহী চৌধুরী ও দলের মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নানের জন্য দুটি আসন চাইতে পারেন। পত্রিকাটি ভিন্ন এক প্রতিবেদনে লিখেছে, কর্নেল (অব.) অলি নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও থাকতে পারেন।

এদিকে ২০-দলীয় জোট থেকে দুটি শরিক দল চলে যাওয়া নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, বিএনপি তাদের ফেরানোর কোনো চেষ্টা করবে না। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০-দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান পত্রিকাকে বলেছেন, ‘তারা যেসব কারণ দেখিয়ে জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন, তা সঠিক নয়। ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সব সিদ্ধান্ত নিই। কাউকে অবমূল্যায়ন করা হয়নি। আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে নানা ষড়যন্ত্র চলছে।’ নজরুল ইসলাম খান যা-ই বলুন, ২০-দলের অপরাপর শরিক দলগুলো যে বেশ কিছুদিন ধরেই বিএনপির কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ, তা অপ্রকাশিত থাকেনি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারারুদ্ধ হওয়ার পর এলডিপি প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ২০-দলের কোনো সভায় উপস্থিত থাকেননি। তা ছাড়া জোটনেত্রীর কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে জোটগতভাবে কোনো কর্মসূচিও পালন করা হয়নি। গত আট মাসে বিএনপি যে কর্মসূচিগুলো পালন করেছে, সেগুলোতে ২০-দলের শরিকদের ডাকা হয়নি। এই নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। পুরনো মিত্রদের অবহেলা করে নতুন মিত্রের সন্ধানে সময় ব্যয় করা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। অনেকেই বলছেন, বিএনপির এই নতুন মিত্র খোঁজার প্রকল্প ফলপ্রসূ হয়নি। তারা যার ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করতে চেয়েছিলেন, সেই বি. চৌধুরীর হঠাৎ অ্যাবাউট টার্ন বিএনপিকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল বলছে, বিএনপির এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। একদিকে যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য তারা গড়তে চেয়েছিল, শুরুতেই তা হোঁচট খেল বিকল্পধারা সরে যাওয়ায়। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের সহযাত্রী দুটি দল জোট ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আর নির্বাচন এবং আসন বণ্টন প্রশ্নে যদি নতুন পার্টনারদের সঙ্গে মতের মিল না হয় এবং একই প্রশ্নে যদি ২০-দলীয় জোটের আরো কোনো শরিক দল জোট ত্যাগ করে, তাহলে বিএনপি সম্মুখীন হবে ভীষণ বড় ধরনের সঙ্কটের। একই সঙ্গে কর্নেল অলি এবং বি. চৌধুরী যদি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে বা জোটবদ্ধ হয়, তাহলে সেটা হবে বিএনপির জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া। নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন যে রাজনৈতিক মেরুকরণ হবে, তাতে বিএনপির বন্ধুহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে- এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ।

আরেকটি বিষয় রয়েছে বিএনপির জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ১৯ বছরের পথচলার সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপি যে এ মুহূর্তে বেশ অস্বস্তিতে আছে তা অপ্রকাশিত নেই। জামায়াত ত্যাগ ইস্যুকে অজুহাত বানিয়ে বিকল্পধারা ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সটকে পড়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য তিন শরিকও জামায়াত ইস্যুতে প্রায় একই মনোভাব পোষণ করে। নতুন শরিকদের মন রক্ষার জন্য বিএনপি যদি জামায়াতকে দূরে সরিয়ে দেয়, তাহলে ভোটের রাজনীতিতে বিপাকেই পড়তে হবে দলটিকে।

এদিকে সামনে বিএনপির জন্য আরো কঠিন সময় আসছে- এমন কথাও বলছেন অনেকে। গত ২ অক্টোবরের বাংলাদেশের খবরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বরের জনসভা থেকে বিএনপি যেসব দাবি পেশ করেছিল, পরদিনই সরকারের পক্ষ থেকে তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে দলটির উঁচু পর্যায়ের নেতারা অবশ্য বলছেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ওইসব দাবি তারা আদায় করবেন। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এ বিষয়ে সন্দিহান। কেননা, এর আগে পর পর দুটি আন্দোলনে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। তাই মামলায় জর্জরিত দলটির নেতাকর্মীরা দাবি আদায়ের আন্দোলনে আবার কতটা ঝুঁকি নেবে তা বলা মুশকিল। তার ওপর যদি নতুন জোট গঠনের কারণে পুরনো সহযাত্রীরা পেছন থেকে সরে যায় তাহলে বিএনপিকে পড়তে হবে কঠিন পরিস্থিতিতে।

অধিকতর লাভের আশায় বিএনপি ২০-দলীয় জোটের বাইরে আরেকটি জোট গঠন করল। আর সে জোটে তাদের পুরনো মিত্রদের কারোরই ঠাঁই হলো না। হবে এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বরং নতুন জোট প্রশ্নে পুরনো জোটে বড়সড় ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সেজন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে বিএনপি লাভবান হলো, নাকি ক্ষতির পাল্লা ভারি করে তুলল? আগামী দিনের রাজনীতির সমীকরণ থেকেই এর সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।  

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads