• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৭৫০ মিটার এখন দৃশ্যমান

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান

  • আ.ব.ম রবিউল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২১ অক্টোবর ২০১৮

বহুল আলোচিত কিন্তু বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু। দেশের সীমানা  পেরিয়ে আন্তর্জান্তিক পর্যায়ে এই সেতুর প্রাসঙ্গিকতা এখন ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নানা সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে এই সেতুটি নির্মাণের ফলে। আবার ১৬ কোটি মানুষের অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এই সেতু। নির্মাণ শুরু হওয়ার পর নানা কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর ১৬ কোটি মানুষের চ্যালেঞ্জের এই সেতু। একটা সময় প্রায় সারা বিশ্বের মানুষ ধরেই নিয়েছিল যে, এই সেতু নির্মাণ আর সম্ভব নয়। কিন্তু বাঙালি থেমে যাওয়ার জাতি নয়। পরাজিত হওয়ার জাতি নয়। তাই সব জল্পনা-কল্পনার অবসান শেষে বিশাল বাজেটের এই সেতু এখন দৃশ্যমান। নদীর দুই পারেরসহ ১৬ কোটি মানুষ এই সেতুকে নিয়ে তাই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।

আমাজান নদীর পরই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরস্রোতা ও প্রমত্তা নদী পদ্মা। এই নদীর ওপরই দেশের সবচেয়ে বড় আর ব্যয়বহুল সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। মূল পদ্মা সেতুসহ পুরো প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজ এগিয়েছে ৭০ শতাংশ।

রেলওয়ে সূত্র জানাচ্ছে, এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু দিয়ে জাজিরা ও শিবচর হয়ে মাওয়া ও ভাঙ্গার মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপিত হবে। চীন সরকার মনোনীত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড ভিটুজি ব্যবস্থায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ খাতে চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ২ হাজার ৬৬৭ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ঋণচুক্তি হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ২৩ কিলোমিটার এলিভেটর রেলপথ নির্মিত হবে। এতে একাধিক এলিভেটরসহ দুটি প্লাটফর্ম, একটি মেইন লাইন ও দুটি লুপ লাইন নির্মাণ করা হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট) এই প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।

জাজিরা ও মাওয়ার মধ্যে ৬ দশমিক ১ কিলেমিটার দীর্ঘ সেতুর ৮৫০ মিটার এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। জাজিরায় পাঁচটি ও মাওয়ায় একটি স্প্যান বসানো হয়েছে। পুরো প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।

দোতলা কাঠামোর এ সেতুর ওপর দিয়ে চলবে গাড়ি, নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে রেলপথ হবে। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়া প্রান্তে সেতুটির নামফলক উদ্বোধন করেছেন।

দেশে প্রথমবারের মতো পদ্মা সেতু হয়ে ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের কাজ এগিয়েছে ৭০ শতাংশ।

মূল পদ্মা সেতু বসানো হবে ৪২টি পিলারের ওপর। এসব পিলার বা খুঁটিতে বসানো হবে ৪১টি স্প্যান। এ পর্যন্ত ১৪টি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। বসানো হয়েছে ছয়টি স্টিলের ধূসর রঙা স্প্যান। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে সেতুর ৩৭ থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত ছয়টি পিলার নির্মাণের পর বসানো হয়েছে পাঁচটি স্প্যান। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল জাজিরায়। গত বুধবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে প্রথম স্প্যান বসানো হয়।

বহুমুখী এই সেতুতে ৪১টি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হলে ট্রেন চালানোর জন্য এগুলোর ওপর ২ হাজার ৯৫৯টি রেলস্লাব বসানো হবে। এর মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে আটটি বসানো হয়েছে। সেতুর ৪২টি পিলারের জন্য ২৯৮টি পাইলের দুই-তৃতীয়াংশের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরায় উড়ালপথের (ভায়াডাক্ট) জন্য যথাক্রমে ৪০টি ও ৩৭টি পিলার নির্মাণ করতে হবে। এগুলোর জন্য যথাক্রমে ১৯৩টি ও ১৭২টি পাইল নির্মাণের কাজ চলছে।

জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চালানোর পরিকল্পনা ছিল। তবে নদীর তলদেশের জটিল অবস্থাসহ চারটি কারণে প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। মূল সেতু নির্মাণে ২৩ মাস অতিরিক্ত সময় দাবি করেছিল নির্মাণ কোম্পানিগুলো। তবে সঠিক যুক্তি দেখাতে না পারায় সেতু বিভাগ তা আমলে নেয়নি। 

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করতে আরো এক বছর সময় চাওয়া হয়েছে। সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত সাত পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাব গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাঠানো হয় সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) এবং পরিকল্পনা কমিশনে। কাজ দেরির জন্য বড় কারণ হিসেবে নদীর তলদেশের গভীরে নরম মাটির স্তর থাকায় সেতুর পিলার স্থাপনে সমস্যা, ২২টি পিলারের নতুন নকশা প্রণয়ন, নদীভাঙন ও প্রবল স্রোতের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

সেতু বিভাগ আরো জানাচ্ছে, প্রকল্পের নদী শাসন কাজের চুক্তিতে ছয় কোটি ঘনমিটার বা ২১২ কোটি ঘনফুট খননের কথা উল্লেখ আছে। জাজিরার মূল সেতুর উজান ও ভাটির ডুবোচরে কিছু স্থান চিহ্নিত করা হয়েছিল খননের জন্য। সেখানে চাষাবাদ বা জনবসতি ছিল না। কিন্তু নদীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের কারণে চিহ্নিত স্থানগুলো পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় জমি অধিগ্রহণ দরকার হয়। তাই অতিরিক্ত ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয় গত জুনে। মূল নদীর ৪০টি পিলারের ১৪টির পাইলের নকশা নতুন করে করতে হয়। আটটি পিলারের পাইলের কাজও স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। ২২টি পিলারের পাইলে নতুন করে নকশা করতে হচ্ছে। ১৫টি পিলারের পাইলে নতুন নকশা ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে। আরো সাতটি নকশা করা হচ্ছে। সেতুর মূল অংশে ৪১টি ইস্পাতের ট্রাসের (সেতু ধরে রাখার কাঠামো) স্প্যান রয়েছে। সেতুর কিছু অংশ সোজা, কিছু অংশে আনুভূমিক ও উলম্ব বাঁক রয়েছে। এসব নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও কাজ এগোচ্ছে। বাকি কাজ একটা সময় শেষ হবে। স্বপ্নের সেতু দৃশ্যমান হবে। উন্নয়নের নতুন ফলক হবে এই সেতু। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের বৃহৎ কিছু রাষ্ট্র আমাদের বিপক্ষে ছিল, তারপরও আমরা বিজয় লাভ করেছি। পদ্মা সেতুতেও বিশ্বের কোনো কোনো সংস্থার ‘না’ শব্দটি এসেছিল। আমরা ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। পদ্মা সেতু জয়যুক্ত হয়েছে।

 

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads