• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪২৯
দিশারী সাংবাদিক আতাউস সামাদ

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক প্রয়াত আতাউস সামাদ

সংগৃহীত ছবি

মতামত

দিশারী সাংবাদিক আতাউস সামাদ

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ৩১ অক্টোবর ২০১৮

আতাউস সামাদ বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম প্রধান দিশারী পুরুষ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগে জীবনের শেষ দিনগুলোতেও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন এই পরিশ্রমী সাংবাদিক। মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগেও দৈনিকটির অফিসে গিয়ে কাজ করেছেন তিনি। বিষয়টি অবশ্যই অবিশ্বাস্য। কিন্তু সেটাই সম্ভব করে গেছেন আতাউস সামাদ।

১৯৫৯ সালে সাংবাদিকতা শুরু করার পর আতাউস সামাদকে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছিল সামরিক ও স্বৈরশাসনের অধীনে— প্রথমে (১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত) পাকিস্তানের তথাকথিত ‘লৌহ মানব’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এবং পরবর্তী সময়ে (১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। শ্বাসরুদ্ধকর সেই বছরগুলোতে দুর্দান্ত সাহসী ছিল আতাউস সামাদের ভূমিকা। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দারা বিরামহীনভাবে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে, প্রলোভনও কম দেখানো হয়নি। কিন্তু ভয়ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে এবং প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন চালিয়েও তাকে সত্য প্রকাশ করা থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি এমনকি গ্রেফতারও বরণ করেছেন।

১৯৮০-এর দশকের ওই দিনগুলোতে আতাউস সামাদের পাঠানো খবর শোনার জন্য মানুষ সাগ্রহে বিবিসি রেডিও খুলে বসে থাকত। তার নিজের কণ্ঠেও অনেক খবর শোনা যেত। সে সময় মোবাইল দূরে থাকুক, সাধারণ বা ল্যান্ড টেলিফোনও খুব কম মানুষেরই ছিল। ফলে স্বৈরশাসকের প্রচণ্ড দমনমূলক পদক্ষেপের মুখে দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন। আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কেও তারা জানার সুযোগ পেতেন না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আতাউস সামাদই প্রধান ভরসা হয়ে উঠতেন। বিবিসিতে প্রচারিত তার খবরই নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও উজ্জীবিত করত। সেদিক থেকে সামরিক স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে আতাউস সামাদের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্তও গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি তার এই অবস্থানকে বজায় রেখেছিলেন। প্রয়োজনের সময়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকাও পালন করেছেন তিনি।

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ছিল আতাউস সামাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি ঘটনা ও তথ্যকে। কোনো বিষয়ের সঙ্গে ভিন্নমত থাকলেও সে সংক্রান্ত সঠিক তথ্য বা খবর প্রকাশের ব্যাপারে তিনি সৎ থাকতেন। কোনো তথ্যেরই বিকৃতি ঘটাতেন না। তার সঙ্গে বা অধীনে যারা সাংবাদিকতা করেছেন, তাদেরও তিনি সঠিক তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সততা বজায় রাখার তাগিদ দিতেন। অনুসন্ধান বা খবর খুঁজে বের করার ব্যাপারে তার দৃষ্টি ছিল খুবই তীক্ষ। এমন অনেক বিষয়েই তিনি রিপোর্ট করেছেন ও অন্যদের দিয়ে রিপোর্ট করিয়েছেন— যেগুলো সহজে কারো চোখেই পড়ত না। এ রকম অনেক খবরই পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসবের মাধ্যমে দেশ ও জাতি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে। সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের যেকোনো সঙ্কট ও দুঃসময়ে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন আতাউস সামাদ।

অতুলনীয় ছিল তার দেশপ্রেম। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং সীমান্তে হত্যাকাণ্ড থেকে ফারাক্কা বাঁধের কুফল ও পানি আগ্রাসন পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থের বিভিন্ন প্রশ্নে তিনি আপসহীন দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন আতাউস সমাদ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দিনগুলোতে অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হবে। ৬ দফা উপস্থাপনার পর আন্দোলন প্রচেষ্টার প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৬৬ সালের ৯ মে গ্রেফতার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে তাকে আগরতলা (ষড়যন্ত্র) মামলার প্রধান আসামি করেছিল আইয়ুব খানের সরকার। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে নেওয়া হয়েছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে বন্দি থাকা অবস্থাতেই মাসের পর মাস বিচারের নামে কার্যক্রম চালানো হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও এই মামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষে সে সময় কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ওদিকে ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। শেখ মুজিব প্রথমে যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯৫৩ সালে দলটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ নামের পৃথক দল করলেও মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের সম্পর্ক সব সময় ছিল পিতা ও পুত্রের মতো। আগরতলা (ষড়যন্ত্র) মামলা চলাকালে সাংবাদিকরা ক্যান্টনমেন্টের বিশেষ সামরিক আদালতে যাওয়ার সুযোগ পেতেন। তারা সংক্ষেপে এবং ইশারা-ইঙ্গিতে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথাও বলতে পারতেন। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরের দিকে আগরতলা মামলার রায় ঘোষণা যখন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল শেখ মুজিব তখন ফয়েজ আহমদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আতাউস সামাদ প্রমুখ সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘বুড়ারে খবর দে।’

‘বুড়া’ বলতে মওলানা ভাসানীকে বুঝিয়েছিলেন শেখ মুজিব। খবর দেওয়ার জন্য সন্তোষে গিয়েছিলেন সাংবাদিক আতাউস সামাদ। সব শুনে মওলানা ভাসানী জানতে চেয়েছিলেন, ‘মজিবর নিজে কইছে?’ আতাউস সামাদ হ্যাঁ সূচক জবাব দেওয়ার পরই মাঠে নেমেছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানের বিরাট জনসভায় ফরাসী বিপ্লবের মতো ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। দেশে তখন ছাত্রসমাজের ১১-দফা ভিত্তিক আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছিল। এরই প্রচণ্ড চাপে সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান আগরতলা (ষড়যন্ত্র) মামলা প্রত্যাহার করতে এবং প্রধান অভিযুক্ত শেখ মুজিবসহ সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন (২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)। পরবর্তীকালে মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিব দুজনই আতাউস সামাদের এই সাহসী ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে লিখেছেন ফয়েজ আহমদ এবং আবদুল গাফফার চৌধুরীও। আতাউস সামাদের নিজের মুখে শুনেছি আমরাও।

রাজনীতির পাশাপাশি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আতাউস সামাদ ছিলেন খোলা মনের মানুষ। ওয়াক্তিয়া নামাজ আদায় করতেন তিনি নিয়মিতভাবে। রোজাও রাখতেন, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভান করতেন না। বিবিসির সাংবাদিক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠা আতাউস সামাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি রয়েছে। অসাধারণ ছিল তার দেশপ্রেম। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তো বটেই, সব সরকারও তাকে যথেষ্ট সমীহ করত। অনেকেই পরামর্শের জন্য তার কাছে যেতেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি বর্তমানে অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ দৈনিক আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও তিনি কলাম লিখেছেন। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায়ই তার সান্নিধ্যে যাওয়ার এবং তার সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছিল। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে তার সঙ্গে। এসব বিষয়ে পরবর্তীকালে লেখার ইচ্ছা রইল।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর হলেও ২০০৯ সালে দলটি ক্ষমতায় আসার পর খুনের তথা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা লাফিয়ে বেড়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে, যেন মানুষের জীবন কোনো ছেলেখেলার বিষয়! অথচ আইনের চোখে প্রত্যেক মানুষেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে। আতাউস সামাদও মনে করতেন, অপরাধ দমন ও নির্মূল করা সত্যি উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে যদি বিরোধী দলকে দমনের কাজে ব্যস্ত না রাখা হয় এবং পুলিশ যদি সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেও স্বাধীনভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে দেশে হত্যা-সন্ত্রাসসহ অপরাধ দমন ও নির্মূল করাটা সময়ের বিষয়ে পরিণত হতে পারে। চিন্তা ও ব্যাখ্যার এই দৃষ্টিকোণ থেকেই গুম ও দমন-নির্যাতনের তীব্র বিরোধিতা করে গেছেন আতাউস সামাদ।

এভাবে সব মিলিয়েই আপসহীন এক দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করে গেছেন আতাউস সামাদ। সে কারণেই দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামী সবার উচিত মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান এই দিশারী পুরুষের দেখিয়ে যাওয়া পথে এগিয়ে যাওয়া, মরহুম আতাউস সামাদকে বাঁচিয়ে রাখা।

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads