• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

উন্নয়নশীল অগ্রযাত্রায় কৃষি খাত

  • মো. আল-মামুন
  • প্রকাশিত ০৬ নভেম্বর ২০১৮

কৃষিকে ঘিরেই মানুষের সভ্যতার জাগরণ শুরু। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন তথা স্বনির্ভরতা অর্জনে আবহমানকাল ধরে কৃষি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুরোটা জুড়েই ছিল কৃষি। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে রফতানি আয় ছিল মাত্র ৩৪৮ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৯০ ভাগ আসত পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে। পরবর্তী সময়ে শিল্প ও বাণিজ্য সেবা খাতের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটলেও দীর্ঘকাল এগুলোও ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ফলে কৃষি হয়ে উঠেছে এ দেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের অধিকাংশ উপাদান আসে কৃষি থেকে। কৃষি বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। এ দেশের আপামর জনসাধারণের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় বিদ্যমান ভাত, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, শাক-সবজি, ফল-ফলাদি উৎপাদনে ধারাবাহিকভাবে কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদগণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। কৃষি খাতের ক্রমাগত উন্নতির ফলেই সম্প্রতি জাতিসংঘ থেকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও বাড়তি জনসংখ্যার বসতবাড়ি নির্মাণে প্রতিবছর প্রায় ০.৭ শতাংশ হারে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিবছর জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ হারে প্রায় ২৩ লাখ। জনবহুল এ দেশের সীমিত চাষের জমি, জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে টেকসই কৃষি উন্নয়নে রয়েছে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং লাভজনক কৃষি খাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ফসল, প্রাণিসম্পদ, মৎস্যসম্পদ, কৃষি প্রকৌশল, কৃষি অর্থনীতি এবং কৃষি শিল্প ও বাণিজ্যে যথোপযুক্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবন, হস্তান্তর এবং উপকরণ ব্যবস্থাপনায় কৃষি বিজ্ঞানীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আগামী দিনের বর্ধিত খাদ্যের চাহিদা পূরণ, পুষ্টি সমস্যা নিরসন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষিপণ্যের আমদানি হ্রাস ও রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের আওতাধীন ১৩টি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং ৩টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এই পর্যন্ত ঘাত সহিষ্ণু (খরা, লবণাক্ততা, বন্যা) জাতসহ বিভিন্ন ফসলের সর্বমোট ৭৬০টি জাত ও ৭৫০টিরও অধিক কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। তা ছাড়া পাটের জেনোম সিকুয়েন্স উন্মোচন ও মেধাস্বত্ব অর্জন করা হয়েছে। আধুনিক কৃষিবিষয়ক এসব গবেষণা ও আবিষ্কারে বাংলাদেশের কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত হয়েছে।

কৃষকদের শ্রম, কৃষি সম্প্রসারণবিদদের তদারকি, কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও সরকারের সদিচ্ছায় কৃষিতে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশগুণ। প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। লবণাক্ততা, খরা, জলাবদ্ধতাসহনশীল, জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানসহ ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। নিবিড় সবজি চাষের মাধ্যমে ২০১৬-১৭ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ৪২ হাজার টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে আছে। আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম। আলু উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম। পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় হলেও পাট রফতানিতে বিশ্বে প্রথম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে পাট ও পাটজাতীয় ফসলের চাষাবাদের মাধ্যমে ৯১ লাখ ৭২ হাজার বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। ফলে এ সময়ে কাঁচাপাট ও পাটজাত পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ৯৬ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। এ ছাড়া সম্প্রতি পাটের আঁশের মান, দৈর্ঘ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী চারটি জিন এবং ক্ষতিকারক ছত্রাক গধপৎড়ঢ়যড়সরহধ ঢ়যধংবড়ষরহধ-এর তিনটি জিনের পেটেন্ট (কৃতিস্বত্ব) পেয়েছে বাংলাদেশ। খাটো জাতের নারিকেল, মাল্টা প্রবর্তনসহ অপ্রচলিত, প্রচলিত বিদেশি ফল চাষে জ্যামিতিক বিস্তার অব্যাহত রয়েছে। কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। স্থিরমূল্যে ২০১৬-১৭ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪.৭৯ শতাংশ। ১/২ ফসলি জমি ৪ ফসলি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন, যা সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। প্রায় সব শিল্পই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অর্থনীতিতে কৃষিসহ অন্যান্য খাতের প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মেয়াদকালে বিদ্যমান ৮২.১ শতাংশ দারিদ্র্যের হার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী মেয়াদকালে ২৪.৮ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় সফল অভিযোজনের ফলে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে।

কৃষির সার্বিক উন্নয়নে কৃষিবান্ধব নীতি ও সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। কৃষককে মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষক হিসাব উন্মুক্তকরণের সুযোগ দেওয়ায় বর্তমানে ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে, যেখানে বর্তমানে স্থিতি ২৮২ কোটি টাকা। সার, বীজসহ সব কৃষি উপকরণের মূল্যহ্রাস, কৃষকদের সহজশর্তে ও স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা প্রদান, কৃষিতে ভর্তুকি, বাড়তি সেচ সুবিধা, রেকর্ড পরিমাণ কৃষিঋণ বিতরণ, সম্প্রসারিত কৃষি গবেষণা, কৃষক ডাটাবেজ তৈরি, কৃষি জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ, কৃষি উপকরণ আমদানিতে সহায়তা প্রদান মূলত কৃষির ব্যাপারে সরকারি সদিচ্ছার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কৃষিকে ডিজিটাল করে আরো কৃষকবান্ধব করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমনকি মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো এগিয়ে আসছে। ই-কৃষির সাফল্যজনক প্রবর্তন করা হয়েছে। দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কলসেন্টার ১৬১২৩, কৃষি কমিউনিটি রেডিও এফএম ৯৮.৮, কৃষি তথ্য বাতায়ন, কৃষকবন্ধু ফোন ৩৩৩১, মাল্টিমিডিয়া ই-বুকসহ সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের আইসিটি যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কৃষিবিষয়ক তথ্যাদি দ্রুত আদান-প্রদান এবং সবার জন্য কৃষি তথ্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।

কৃষি খাতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্ব বাস্তবায়িত হলে এর আমূল পরিবর্তন সম্ভব। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রত্যেক উপজেলায় ফসল সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৩, জাতীয় বীজনীতি, জাতীয় জৈব কৃষিনীতি ২০১৬, জাতীয় খাদ্যনীতি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যের (এসডিজি) সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের জনগণের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা বিধানকল্পে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, পশ্চাৎপদ নৃগোষ্ঠীর জন্য পাহাড়ি অঞ্চলে ফলের বাগান সৃজন ও সবজি আবাদের বিস্তার এবং অনুন্নত চর ও হাওর অঞ্চলে সমন্বিত কৃষি সহায়ক প্রকল্পসহ বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। রাজধানীসহ শহর এলাকাগুলোতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য স্থায়ীভাবে খোলাবাজার চালু করা হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই উপকৃত হবেন। কৃষি উৎপাদনকে ভবিষ্যৎ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আকস্মিক বন্যা, লবণাক্ততা, খরা ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ঘাতসহিষ্ণু উচ্চফলনশীল এবং জৈব প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষির বহুমুখীকরণের পাশাপাশি কৃষিজাত শিল্প কারখানা এবং উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ক্রমে বাজার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার পাশাপাশি রবিশস্যসহ কৃষিজাত অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে মনোযোগী এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র যেমন আরো বিস্তৃত হবে, তেমনি রফতানি তালিকাও হবে দীর্ঘ।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু বিপর্যয় তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আবহাওয়া ও তাপমাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপখাইয়ে চলার মতো কৃষিপ্রযুক্তি ও ফসলের জাত উদ্ভাবনে অর্থনীতির নতুন এক দিগন্ত দেখছে দেশবাসী। সঠিক শস্যবিন্যাস অনুসরণের লক্ষ্যে জলবায়ু ও মৃত্তিকার উপযোগিতা অনুযায়ী ১৭টি ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে বায়োটেক ও জিএম শস্যের প্রবর্তন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কৃষি খাতকে যদি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারি, তবে শিল্প খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব হবে, আমরা পারব উন্নতির সোপান পাড়ি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে।

 

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads