• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমলেও দেশে কমেনি

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ১০ নভেম্বর ২০১৮

নিত্যপণ্যের মধ্যে চিনি অন্যতম। চিনি ছাড়া মানুষের এক মুহূর্তও চলে না। উৎপাদনের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকার পরও শুধু সরকারি ভ্রান্ত নীতির কারণে চিনি এখন আমদানিনির্ভর। আমাদের দেশটি কৃষিনির্ভর। কৃষিই আমাদের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন। অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশ। এই জনগোষ্ঠীর মুখে আহার জোগান দিচ্ছে কৃষক। কৃষকের নিরন্তর প্রচেষ্টায় দেশের অর্থনীতিও ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হচ্ছে। তবু যেন কৃষকের স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে না।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান। তখন আমি মাধ্যমিকের ছাত্র। সবকিছু বোঝার সক্ষমতা না থাকলেও লোকমুখে শুনতাম, আমাদের দেশে চিনি উৎপাদন হলেও বাংলাদেশিদের কাছে চিনির বড় কহর। এও শুনতাম, দেশ স্বাধীন হলে মানুষের কাছে চিনি সহজলভ্য হবে। সে সময় দেওয়ানগঞ্জ চিনিকলের কী রমরমা চেহারা, যা নিজের চোখে দেখারও সুযোগ হয়েছিল। চিনিকলের পাশে ফুফুর বাসা। আমার দাদি-মায়ের সঙ্গে ফুফুর বাসায় গেলে চিনিকলের ভেঁপুর শব্দ শুনতাম। আর আমার ফুফা চিনিকলে চাকরি করতেন। সে সুবাদে একাধিকবার চিনিকলের কর্মযজ্ঞ দেখেছি। আমিও ভাবতাম, দেশেই চিনি উৎপাদন হয়, তারপরও চিনির আবদার ধরলে মা তা সহসা পূরণ করতে চায়নি। যদিও মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে আমার জন্ম। বাবার চাষের জমিও ছিল প্রচুর। গোলাভরা ধান আর মাছে পরিপূর্ণ ছিল বাবা-মায়ের সংসার। আমিও ভাবতাম, হয়তো দেশটি স্বাধীন হলে পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠীর শোষণ-দুঃশাসন বন্ধ হবে। বাঙালি হিসেবে মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করতে পারব। ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির ওপর আমার একটু বেশি আগ্রহ ছিল। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো সভা-সমাবেশ হলে সেখানে স্বইচ্ছায় হাজির হতাম।

একদিন প্রয়াত মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর জনসভার খবর শুনলাম। তিনি তৎকালীন চিলমারী থানার (বর্তমানে উপজেলা) ডাকবাংলো মাঠের জনসভায় বক্তৃতা করবেন। যতদূর মনে পড়ে সে সময় আমি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। বিকালে জনসভাস্থলে হাজির হয়ে কৃষক-দরদি জননেতা মওনালা ভাসানীকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। জনসভাস্থলে পুলিশ পাহারাও ছিল। তখন পুলিশকে বেশ ভয় পেতাম। পুলিশের শৃঙ্খলাও ছিল। তখন গ্রামের একজন চৌকিদার ও লাঠি হাতে থাকা দফাদারদের কী দোর্দণ্ড প্রভাব ছিল! মানুষ তাদেরকেও ভয় করত। জনসভায় পুলিশ দেখে ভাবলাম, হয়তো প্রধান বক্তা সরকারবিরোধী তেমন কিছুই বলবেন না। কিন্তু বক্তৃতার সময় শুনলাম, মওলানা ভাসানী পাকিস্তানি শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কতই না অভিযোগ করে বক্তৃতা করলেন। একটি পুলিশ টু-শব্দটিও করলেন না। তবে দেখলাম, মঞ্চের পাশে এক পুলিশ কর্মকর্তা টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে বক্তৃতার সারমর্ম লিপিবদ্ধ করছেন। তার বক্তব্যে শুনলাম পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর শোষণের নির্মম কাহিনী। সেদিন তিনিও বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে মানুষ স্বল্পমূল্যে চিনি খেতে পারবে।

দেশ স্বাধীন হলো ঠিকই। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক দেশ থেকে বিতাড়িত হলো; কিন্তু সহজলভ্য চিনি খাওয়ার সে আকাঙ্ক্ষা আর পূরণ হলো না। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৭ বছর আগে। এরই মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে স্থাপিত বাঙালির সম্পদ চিনিকলগুলো রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হলো। চাষিরা ন্যায্যমূল্যের অভাবে আখ চাষ করা ছেড়েই দিল। ধীরে ধীরে চিনিকলগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। বাঙালি জাতির স্বপ্নের পান্তা ভাতে চিনি খাওয়ার স্বপ্ন নিমিষেই হারিয়ে গেল। বেড়ে গেল চিনির বাজারমূল্য। সরকার চিনির চাহিদা পূরণে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানির সুযোগ করে দিল। দেশীয় নব্য শোষকগোষ্ঠীর মধ্যে মাত্র ৭-৮টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে দেশীয়ভাবে তা পরিশোধন করে বাজারজাত ও বিপণন করছে। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো চিনি উৎপাদন করে ক্রেতার অভাবে মাসের পর মাস ধরে মজুত রাখছে। যে কারণে মজুতে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেই চিনিগুলো। ক্রেতার ধর্মই হচ্ছে, যেখানে কম দামে পণ্য পাবে, সেখানেই কিনবে। যেহেতু দেশীয় চিনিকলের উৎপাদিত চিনির দাম বেশি, সেহেতু দেশীয় চিনি ভোক্তারা কেনেন না। এসব চিনিকলের অনুকূলে বছরে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা দিয়ে একদিকে যেমন আখ কিনে চাষিদের মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হয় না, অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে বাড়তি মূল্যে চিনি বিক্রি করতে হয়। অথচ সরকার এ খাতে ভর্তুকি দিয়ে আখ চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি করে চিনিকলগুলোকে নির্বিঘ্নে উৎপাদনে রাখার ব্যবস্থা নিলে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত চিনিতে ভোক্তার শতভাগ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব ছিল। ক্ষমতাসীনরা সেদিকে নজর না দিয়ে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানির সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে ইতোমধ্যে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত করেছে। হয়তো কোনো রাষ্ট্রে কোনো কারণে কোনো পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে সরকার ভোক্তার স্বার্থে সে পণ্য আমদানি করে থাকে, যা সাময়িক। কিন্তু চিনির মতো একটি অতি আবশ্যিক পণ্য প্রায় এক ‘যুগ’ সময় ধরে কেন এবং কোন যুক্তিতে আমদানি করা হচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তবে একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোয় ক্ষমতাসীনরা শ্রেণিস্বার্থ রক্ষায় সাধারণ ভোক্তার স্বার্থ উপেক্ষা করে হলেও পুঁজিপতিদের নানাভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। চিনির ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটছে। তা না হলে কেন রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী না করে মান্ধাতা আমলের মিল-মেশিনারিজ ব্যবহার করে বাড়তি খরচে চিনি উৎপাদন করা হচ্ছে? মূলত সরকারি ভ্রান্ত নীতিমালা, পক্ষপাতিত্ব, এক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করতেই সরকার দেশীয় চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়ন করছে না। এ কারণে বলতে দ্বিধা নেই যে, জনগণের স্বাধীনতার যে আশা-আকাঙ্ক্ষা তা প্রতি পদে পদেই লঙ্ঘিত হচ্ছে। বিদেশি শোষকগোষ্ঠীর বদলে এখন দেশীয় শোষকরা জাতির স্বার্থ ক্ষুণ্ন করেই চলছে।

সম্প্রতি দৈনিক বাংলাদেশের খবরে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ দেশের বাজারে কমেনি। ফলে সে চিনি বিদেশ থেকে কম দামে আমদানি করে দেশীয় বাজারে কয়েকগুণ লাভে বিক্রি করছেন। যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির মূল্য কম, সেখানে দেশীয় বাজারে চিনির মূল্য কম হওয়ার কথা। কিন্তু দেশীয় বাজারে চিনির মূল্য সামান্যতম কমেনি। তার অর্থ, আমদানিকারকরা তুলনামূলক কম দামে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধনের পর দেশীয় বাজারে কয়েকগুণ বেশি লাভে তা বিক্রি করছে।

আমরা মনে করি, দেশীয় চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করে নির্বিঘ্নে উৎপাদনের ব্যবস্থা নিলে চাষিরা আখ চাষাবাদ করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারবে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads