• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

একক পরিবারই বিয়েবিচ্ছেদের প্রধান কারণ

  • রহিমা আক্তার মৌ
  • প্রকাশিত ১৩ নভেম্বর ২০১৮

পরিবার মানেই হাসি-কান্না, ছোট ছোট মান-অভিমান, খুনসুটি আর হই-হুল্লোড়। পরিবার মানেই মা-বাবা-সন্তান, ভাইবোন মিলে এক বন্ধন। কিন্তু এখনকার পরিবারগুলো আর আগের মতো নেই। যৌথ পরিবার খুব একটা চোখেই পড়ে না। কিছুটা বাধ্য হয়ে কিছুটা বাস্তবতার বেড়াজালে গড়ে উঠছে একক পরিবার। যদি পক্ষ-বিপক্ষে দাঁড় করানো হয় যৌথ ও একক পরিবারকে, মনে হয় না কেউ জিততে পারবে। কারণ একক পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা যেমন আছে, তেমনি যৌথ পরিবারেও রয়েছে সুবিধা-অসুবিধা। আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও চাকরিজীবী মেয়েদের সংখ্যা ছিল খুব কম। এখন বেড়েছে অনেক, নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে, হচ্ছে স্বাবলম্বী। একদিকে পরিবার হচ্ছে একক, অন্যদিকে মায়েরা হচ্ছেন চাকরিজীবী। দুই দিক সামাল দিতে হুশ হারিয়ে দুজনের বনিবনা না হয়ে হচ্ছে বিয়েবিচ্ছেদ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত সাত বছরে বিয়েবিচ্ছেদের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। অল্প শিক্ষিত দম্পতিদের চেয়ে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে বিয়েবিচ্ছেদ হচ্ছে বেশি। এজন্য অনেকে শিক্ষিত নারীর জীবিকাকে দোষারোপ করছেন অনেকে, কিন্তু এর পেছনের গল্প অনেকেই খুঁজতে চান না। একজন চাকরিজীবী পুরুষ তার মহিলা সহকর্মীর সঙ্গে ঘুরতে পারেন, খেতে যেতে পারেন। কিন্তু একজন কর্মজীবী নারী যখনই তার সহকর্মীর সঙ্গে বাইরে যান, খেতে যান, ঘুরতে যান, তখনই এই নিয়ে শুরু হয় অশান্তি, যার পরিণাম বিয়েবিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদের ফলে তারা নতুন জীবন বেছে নিলেই তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

মতের অমিল, সমঝোতার অভাব, শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি, পুরুষের আধিপত্য, পরকীয়া- মূলত এসব কারণেই বেশি বিয়েবিচ্ছেদ হচ্ছে। তবে শারীরিক দুর্বলতা, প্রত্যাশা পূরণের অভাব, পরিবারের সদস্যদের অনধিকার চর্চা, ধৈর্যের অভাব, ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্যা হওয়ার ফলেও বিয়েবিচ্ছেদ হচ্ছে অনেক। আসল কারণ হলো যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হওয়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়েবিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর।

দিলারা ও তারিকের ১৬-১৭ বছরের সংসার। প্রথম কয়েক বছর ভালো গেলেও তারিকের নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাইরে, এই নিয়েই শুরু। বাইরে সম্পর্ক আর ঘরে এসে বিবাহিত বউয়ের ওপর অত্যাচার। নুন থেকে চুন খসলেই শারীরিক নির্যাতন, বোনাস হিসেবে মানসিক নির্যাতন তো আছেই। কিছু হলেই তারিক সন্তানদের ডেকে ওদের সামনে শুরু করে কথা কাটাকাটি। দিলারা সন্তানদের ডাকতে নিষেধ করলে তারিক বলে, ‘ওদেরও শোনা দরকার।’ এরপর থেকে ঘরে জোরে কোনো কথা হলেই সন্তানরা ভয় পেতে থাকে, ভাবে এই বুঝি তাদের ডাকতে আসবে। এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন—

‘মা-বাবার বিয়েবিচ্ছেদ হলে বা একই সঙ্গে থেকেও বনিবনা না হলে তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। মা-বাবা যদি সন্তানের সামনে ঝগড়া করেন বা পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকেন, তাহলে সন্তানের ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সবসময় অতি উৎকণ্ঠায় থাকে সেসব সন্তান। সন্তান যখন বড় হয়, তার ব্যক্তিজীবনেও এই প্রভাব পড়ে। তখন পরিবার গঠনকালে মা-বাবার আচরণের প্রতিফলন ঘটতে পারে। যারা নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বড় হয়, দেখা যায়, তাদের আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা কম থাকে। সন্তান জন্মদানের পর দায়িত্ববান হতে হবে। মা-বাবার আচরণ সংবেদনশীল না হলে সন্তানও অসংবেদনশীল আচরণ করবে। সেটা মাথায় রেখে দাম্পত্য জীবনে আচরণ-কথাবার্তায় সচেতন হতে হবে।’

কান্তা গ্রাম থেকে শহরে এসে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের খাতায় বাবা ও মায়ের দুজনের মোবাইল নাম্বারের জায়গায় কান্তা মায়ের নাম্বার দেয়। কারণ ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে গেছে অন্য জায়গায়, তিনি আবার বিয়ে করেছেন। কান্তার মা সন্তানদের কথা ভেবেই আর বিয়ে করেননি। আমাদের সমাজে মেয়েদের পায়ে পায়ে বিপদ, মা পরে আবার বিয়ে করলে মায়ের পরের স্বামী কখনো মেয়ের বাবা হয় না। বরং মেয়ের জীবন অতিষ্ঠ হয়। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। কান্তার বাবা কখনো স্কুলে আসেনি, ওর বন্ধুরা আস্তে আস্তে জানতে পারে ওর বাবা নেই, বন্ধুরা খুবই ভালো, তাই ওকে এমন প্রশ্ন করে না কেউ। কিন্তু অবচেতন মনে কান্তা ঠিক বাবাকে মনে করে।

বিয়েবিচ্ছেদে সন্তানদের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন-

‘সমাজে বিয়েবিচ্ছেদ যে হারে বাড়ছে, সেভাবে মানসিকতার পরিবর্তন আসেনি আমাদের। আমরা মানসিকভাবে সমাজের পরিবর্তন নিতে প্রস্তুত হইনি। যে কারণে মা-বাবার সম্পর্কে কোনো সমস্যা হলে সেই পরিবারের সন্তানকে কিংবা ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানকে কেউ কেউ হেয় করে কথা বলে। এই দোষ সন্তানের নয়। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা একটু সহনশীল হলে বা সন্তানের প্রয়োজনে ছাড় দিলে সন্তানের মনের কষ্ট কিছুটা কমানো যায়। সন্তানের চাওয়া মা-বাবাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তারা বুঝে না বুঝে মনে আঘাত দিয়ে কথা বলেন। এমন কোনো আচরণ করেন, যা সন্তানের মন ছোট করে দেয়।

পরিবারই সবার প্রথম শিক্ষার জায়গা। একটা শিশু বড় হতে হতে ভালো-মন্দ শিখে পরিবার থেকে। পরিবার ওকে ভালো পরিবেশ দিতে পারলে সে সেই মানসিকতায় বড় হয়। পরিবারে ছোটরা বড়দের সম্মান করে দেখলে সেও সম্মান করতে শেখে। বড়রা ছোটদের স্নেহ করতে দেখলে তারাও তাই করতে শেখে। সর্বপ্রথম কথা হলো পরিবারে বাবা-মায়ের সম্পর্কের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ দেখলে তারাও তা করতে শেখে। বাবা-মা দুজনের প্রতি দুজনের সন্দেহ, অশ্রদ্ধা, তিরস্কার দেখলে সন্তানরা সেভাবেই বড় হয়, তার বা তাদের মাথায় সে ধরনের ভাবনা নিয়েই বড় হয়। যা ভবিষ্যতের জন্য খুবই খারাপ, একসময় সে সহপাঠীকে সম্মান করে না, প্রেমিকাকে সম্মান করে না, এমনকি উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করা স্ত্রীকেও। অনেক সময় বাবা-মায়ের কঠিন সিদ্ধান্তের জন্য সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। একসময় কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয় সন্তান। বাবা-মায়ের বিয়েবিচ্ছেদের পর সন্তান কার কাছে থাকবে? একটি সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে বাবা-মা দুজনেরই প্রয়োজন। কিন্তু আদালত তখন রায় দেন সন্তানের ভালো যেখানে হয় সেখানে থাকার।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজীব উল আলম বলেন-

‘সন্তানের সামনে পরস্পরকে ছোট করা উচিত নয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সন্তানই মূলত ভিকটিম হয়ে থাকে। বিয়েবিচ্ছেদে দেখি মা-বাবা পরস্পর পরস্পরকে অনেক ছোট করে অসম্মানজনক কথা বলেন। সেটি সন্তানের মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। মা-বাবা সব সন্তানের কাছে আদর্শ। পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন কোনো কথা বলা উচিত নয়, যাতে সন্তান মা বা বাবা কাউকে ভুল বোঝে।’ একসঙ্গে থাকতে না পারলে সন্তানকে বলতে হবে, ‘স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমাদের আদর্শগত মিল হয়নি। তাই থাকিনি, কিন্তু তোমার পাশে থাকব।’ সন্তান যার কাছেই থাকুক, তাকে মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়াটা জরুরি।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads