• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বালু নদীর মরণদশা

  • সাধন সরকার
  • প্রকাশিত ২৮ নভেম্বর ২০১৮

ঢাকার চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোই ঢাকার প্রাণ। শহরের মধ্যে খাল ও চারপাশে নদীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এমন রাজধানী শহর বিশ্বে বিরল। তবু খালের সঙ্গে নদ-নদীর সংযোগ রেখে জল-সবুজে আধুনিক, টেকসই ও বাসযোগ্য নগর গড়ে তোলা যায়নি। সময়ের ব্যবধানে খাল ও চারপাশের নদীগুলোর চিরচেনা রূপ বদলে গেল। দখল-দূষণের কারণে নদ-নদীগুলোর প্রাণ হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে নদ-নদীগুলো উপযোগিতা হারিয়ে ফেলেছে। জনপদকে ঘিরে সভ্যতার বিকাশ, পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলা, নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় একসময় ঢাকার বালু নদীর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। নদীর দখল-দূষণ, ভরাট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, নদীবিনাশী নানা তৎপরতার কারণে বালু নদীর অবস্থা এখন কাহিল। বালু নদী মূলত শীতলক্ষ্যার শাখা নদী। রূপগঞ্জের ডেমরা এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বালু নদী টঙ্গীতে গিয়ে তুরাগ নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। আবার রাজধানীর উত্তর-পূর্ব এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বালু নদী। নদীর এক পাড়ে রূপগঞ্জ, অন্য পাড়ে ঢাকার খিলগাঁও বালুরপাড়। এ ছাড়া বালু নদী থেকে উৎপত্তি ছোট ছোট দুটি নদী নরাই ও দেবধোলাই ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছোট এই নদী দুটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া (মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, গুলশান, তেজগাঁও, সবুজবাগ, ডেমরা, মতিঝিলসহ আরো এলাকা) বিভিন্ন অংশ দিয়ে শিল্প ও সুয়ারেজের বর্জ্য এসে পড়ছে বালু নদীতে। দখল আর নাব্যসঙ্কটে বালু নদীর প্রবাহ একেবারেই কমে গেছে। দূষণে নদীর পানি কালো কুচকুচে হয়ে গেছে।

কয়েক বছর আগেও এ নদীতে বড় বড় লঞ্চ চলত। বালু নদীকে কেন্দ্র করে এখানকার বহু মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হতো। এই নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও। বালু নদীর পাড় ঘেঁষে হাটবাজার বসত; নৌকা, লঞ্চ, স্টিমারযোগে এখানে ব্যবসায়ীরা আসতেন; বেচাকেনা হতো। এর ফলে নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও সচল ছিল। স্থানীয় জেলেরা এই নদীর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু সেসব এখন ইতিহাস! নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটারের বেশি অংশজুড়ে শুধু দখলের ছড়াছড়ি। নাব্যসঙ্কটে নদী আর চলতে পারছে না! আবার দূষণের কারণে নদীতে কোনো নৌযান চললেই তৈরি হচ্ছে সাদা ফেনা- একসময়ের মিষ্টি পানির বালু নদীর পানির অবস্থা এমনই। এক তথ্যমতে, ঢাকা থেকে দৈনিক ১০ লাখ ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য, বর্ষার সময় প্রায় ৫০ কোটি ঘনমিটার বর্জ্য মেশানো পানিসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার প্রায় কয়েকশ ঘনফুট বর্জ্য প্রতিদিন এ নদীতে পড়ছে। এ ছাড়া শাখা নদীসহ মূল বালু নদীতে রয়েছে কয়েকশ ঝুলন্ত টয়লেট। এসবের বর্জ্যও সরাসরি নদীতে পড়ছে। দূষণের কারণে বালু নদীতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। ফলে নদীপাড়ের জেলেরা অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। শিল্পকারখানার বর্জ্য নদীকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলছে। একদিকে নদীর পানি কমে যাওয়া, অন্যদিকে পানি দূষিত হয়ে যাওয়ায় নদীর পানি দ্বারা সেচ কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পানির অভাবে নদীর পানিনির্ভর অনেক জমিতে সেচ কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে গেছে। আবার সেচকাজে পানি পাওয়া গেলেও তা পচা পানি। পানির সমস্যার কারণে দু-তিন ফসলি বহু জমি এখন এক ফসলি হয়ে গেছে। এ ছাড়া নদীর তীর দখল করে দখলদাররা গড়ে তুলছেন বহুতল ভবন-মার্কেট, অবৈধ স্থাপনা ও ব্যবসাকেন্দ্র। বালু নদীর পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। এতে এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। নদীর পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে নদীতীরবর্তী ফসলি জমিতে উৎপাদনও কমে গেছে। বালু নদী দখল-দূষণের সঙ্গে কারা জড়িত তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়। তথাকথিত প্রভাবশালী বনে যাওয়া অবৈধ দখলদাররা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন দলের নাম ভাঙিয়ে বছরের পর বছর ধরে নদীটির ক্ষতি করে চলেছেন।

রাষ্ট্রীয় সব সম্পদের মধ্যে নদ-নদীই মনে হয় দখল করা সবচেয়ে সহজ! কেননা বালু নদীসহ দেশের বেশিরভাগ নদ-নদী অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। তাই ভয়-ভীতি দূরে ঠেলে জাতীয় সম্পদ নদ-নদীগুলো রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। ঢাকার বালু নদী রক্ষার জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর, স্থানীয় সুশীল সমাজ ও পরিবেশসচেতন সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে বালু নদীসহ ঢাকার আশপাশের অন্য নদীগুলো রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। ফসলি জমিতে পানির চাহিদা পূরণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, জেলেদের নদীনির্ভর জীবন-জীবিকাসহ

সার্বিক পরিবেশ রক্ষার্থে দখল-দূষণের হাত থেকে অবিলম্বে বালু নদীটিকে রক্ষা করা প্রয়োজন। 

 

লেখক : সাবেক ছাত্র, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads