• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

প্রতিবন্ধীরা মূলধারায় আসবে কবে

  • হিমেল আহমেদ
  • প্রকাশিত ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রতিবন্ধীরা এখনো সমাজে অবজ্ঞার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে যা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। বিধাতা এই পৃথিবী শুধু সুস্থ সবল মানুষের বসবাসের জন্য সৃষ্টি করেননি। বিশ্বের সব জীবের বাসস্থল এই পৃথিবী। প্রতিবন্ধীরাও এই সমাজের অংশ। তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা কাম্য নয়। তাদেরও রয়েছে বেঁচে থাকার সমান অধিকার। ৩ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শন এবং তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই এ দিবসটির সূচনা হয়েছে। তবে এই দিবসটি পালনের ইতিহাস পুরনো। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বেলজিয়ামে এক সাংঘাতিক খনি দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যায়। আহত পাঁচ সহস্রাধিক ব্যক্তি চিরজীবনের মতো প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। খাদ্য, কর্ম, চিকিৎসাসহ সর্বক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত ছিল। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার লক্ষ্যে বেশকিছু সামাজিক সংগঠন এগিয়ে আসে। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়- এটা প্রমাণ করতে কাজ করে যায় সামাজিক সংস্থাগুলো। এই রেশ ধরেই জাতিসংঘ প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ হিসেবে প্রতিবন্ধী দিবস পালনের আহ্বান জানায়। তবে দিবস আসে দিবস যায় আর প্রতিবন্ধীরা থেকে যায় আগের মতোই। আমাদের দেশে এখনো পুরোপুরি প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ নির্মাণ হয়ে ওঠেনি। তা না হলে আমরাও প্রতিবন্ধীদের মতো যথেষ্ট সহানুভূতিশীল নই! আমাদের ভোলা উচিত নয় যে প্রতিবন্ধীরাও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা কত, এটা নিয়ে এখনো পরিপূর্ণ জরিপ হয়নি। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা ১৫ জন প্রতিবন্ধী। সেই হিসাবে মোট জনসংখ্যার ২ কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী। দৃশ্যমান শারীরিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৩ থেকে ৫ শতাংশ বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে। বর্তমানে তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে মাত্র ১৩২টি। সাধারণত অধিকাংশ প্রতিবন্ধীই খোদ বাবা-মায়ের হাতে অবহেলার শিকার হচ্ছে। যাদের অধিকাংশই স্বাভাবিক সুবিধা ও অধিকারবঞ্চিত। সরকারসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তবু চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে প্রতিবন্ধীরা। দেশে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে না প্রতিবন্ধী স্কুল। ২০১৬ সালে সরকার সারা দেশে আরো ৬০০টির মতো প্রতিবন্ধী স্কুল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সে পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। দেশে মোট যতটি প্রতিবন্ধী স্কুল রয়েছে, সেগুলোর বেশ কয়েকটি বন্ধ হওয়ার পথে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৪ জেলায় একটি করে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল আছে। এ ছাড়া ৭টি শ্রবণ প্রতিবন্ধী, ৫টি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও ৫৬টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল আছে। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলের মধ্যে সুইড বাংলাদেশেরই আছে ৪৮টি। রাজধানীর মিরপুরে রয়েছে ‘জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র’। তবে স্কুলগুলোতে নেই পর্যাপ্ত স্টুডেন্ট ও শিক্ষক। বেশিরভাগ পিতা-মাতা তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে অনীহা ও অবহেলা দেখান। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার এটি একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা আমি মনে করি। তার সঙ্গে দরিদ্রতার সমস্যা তো আছেই! রাস্তাঘাটে দেখা যায় অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অজুহাত দেখিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়ান। শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী সন্তানদের প্রতি মা-বাবার সচেতন হওয়া জরুরি। শিক্ষিত কোনো মানুষই দেশের বোঝা নয় বরং সম্পদ, এটা ভোলা উচিত নয়। বেশ কয়েকদিন আগে শিক্ষিত প্রতিবন্ধীদের চাকরি দেওয়ার জন্য চাকরি মেলার আয়োজন করা হয়েছিল বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে, যা সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী চাকরি মেলার আয়োজন করা হয়। যেখানে শুধু সাক্ষাৎকারেই চাকরি দেওয়া হয় অসংখ্য শিক্ষিত প্রতিবন্ধীকে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধীরাও অবদান রাখতে পারেন। যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদেরও দেশের সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। তাই প্রতিবন্ধীদেরও শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে জোর দেওয়া উচিত। শিক্ষা ছাড়া মুক্তি মিলবে না এই প্রতিবন্ধীদের। তাই সচেতন ও সহানুভূতিশীল হতে হবে আমাদের। সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সুন্দর সমাজ গঠনে প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধী নয়; বরং নিজের ভাই-বোনের দৃষ্টিতে মিশতে হবে। এই প্রতিবন্ধীরাও আমাদের সঙ্গেই এ সমাজে বাস করে। তারাও এই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads