• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থা রাখতে চাই

  • তারেক শামসুর রেহমান
  • প্রকাশিত ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা, অর্থাৎ অর্থ ও সম্পত্তির হিসাব সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। তারা তাদের সম্পত্তির যে হিসাব জমা দিয়েছেন এবং যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে শুধু অবাকই করেনি, বরং তাদের প্রতি আস্থার জায়গায় একটি বড় ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ উল্লেখ করেছেন, বছরে তার ব্যবসা থেকে আয় হয় ২ লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা। সে হিসেবে তার মাসিক আয় দাঁড়ায় ১৭ হাজার ২০৮ টাকা (পরিবর্তন, ৩০ নভেম্বর)! হলফনামায় আয়ের উৎস বিবরণী থেকে জানা যায় কৃষি খাত, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান বা অন্যান্য ভাড়া, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত বাবদ এরশাদের কোনো আয় নেই।

তবে রাষ্ট্রীয় বিশেষ দূত হিসেবে সম্মানী পান বছরে ১৯ লাখ ৪ হাজার ৬৯৬ টাকা, সংসদ সদস্য হিসেবে বছরে সম্মানী ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ব্যাংকের পরিচালনা সম্মানী পান ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ১০ টাকা। এসবই তার সম্পদ। অথচ কৌশলে উল্লেখ করলেন ব্যবসা থেকে মাসিক আয় ১৭ হাজার ২০৮ টাকা। অথচ রওশন এরশাদের আয় তার স্বামীর আয়ের চাইতে ছয়গুণ বেশি! রাশেদ খান মেনন দীর্ঘদিন বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি এখন চলেন প্রাডো গাড়িতে। দশ বছরে তার বার্ষিক আয় চারগুণ ও অস্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে তিনগুণের বেশি। আর তার স্ত্রীর স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪৯ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ টাকা। তার স্ত্রীর সম্পত্তি বেড়েছে ২২গুণ (প্রিয়.ডটকম, ১ ডিসেম্বর)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক এই মন্ত্রীর হাতে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৮৫ টাকা (বাংলা নিউজ২৪, ১ ডিসেম্বর)। সালমান এফ রহমান বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী। একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। হলফনামা অনুযায়ী তার কোনো বাড়ি নেই। আসবাব নেই (আমাদের সময়.কম, ১ ডিসেম্বর)। অথচ ঐঁৎঁহ ষেড়নধষ জরপয খরংঃ ২০১৮-এ তার নাম রয়েছে বলে জানা যায়। জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার ও তার স্ত্রী রত্না আমিনের ২০গুণ সম্পদ বেড়েছে। দুজনই দশম জাতীয় সংসদে অনির্বাচিত সংসদ সদস্য (যুগান্তর, ১ ডিসেম্বর)। ২০০৮ সালে যেখানে এই দম্পতির সম্পত্তির পরিমাণ ছিল আড়াই কোটি টাকা, সেখানে তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ কোটি টাকা (ঐ)। নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাসিক আয় ৬ লাখ টাকা আর বেগম খালেদা জিয়ার আয় সাড়ে ১২ লাখ (আমাদের সময়.কম, ২ ডিসেম্বর)। এটা গেল একটা দিক। অন্যদিকে দলবদলের হিড়িক পড়েছে। আজীবন যিনি যে রাজনীতি ধারণ করেছিলেন, হঠাৎ তা পরিবর্তন করে শুধু নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য দলবদল করছেন এবং সদ্য যোগ দেওয়া নতুন দল আবার তাদের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নও দিয়েছে। এই দলবদলের রাজনীতি আলোচনার জন্ম দিয়েছে এ কারণেই যে, সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন— এরা কেউই মূল দল থেকে ‘নমিনেশন’ না পেয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গণফোরামে এবং বিএনপিতে। এ ক্ষেত্রে গণফোরামের পাল্লা ভারীই।

গণফোরাম এতদিন অনেকটাই ‘ঘুমিয়ে’ ছিল। সাংগঠনিক তৎপরতা একদমই ছিল না। ৬৪টি জেলায় এদের সাংগঠনিক কমিটিও নেই। কিন্তু ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলেন। মানুষের আগ্রহ বাড়ল। কামাল হোসেন তৎপর হলেন। তার বিদেশ যাওয়া কমে গেল। আর তাই ‘রাজনীতির অতিথি পাখি’রা ভিড় জমাতে শুরু করলেন গণফোরামে। ভাবখানা এই- গণফোরামই হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি! এক সময় বিএনপি আওয়ামীবিরোধী রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। এখন যেন সেই জায়গাটা দখল করে নিল গণফোরাম। তাই ‘রাজনীতির অতিথি পাখি’রা তৎপর হয়েছেন। গোলাম মাওলা রনি তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি পটুয়াখালীর একটি আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে এবং না পেয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন এবং ওই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির। তার অনেক অতীত বক্তব্য এখন ফেসবুকে ভাইরাল, যেখানে তিনি বিএনপি তথা মির্জা ফখরুল সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। মির্জা সাহেব এটা জেনে-শুনেই রনিকে দলে আশ্রয় দিলেন! প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ‘রাজনীতির অতিথি পাখি’দের দলবদলের কারণে দল বা রাজনীতি কতটুকু উন্নত হবে? গণফোরাম বা বিএনপি কি খুব লাভবান হবে? নির্বাচন হবে। নির্বাচনী রাজনীতি এখন তুঙ্গে। তবে এই নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে দিতে পারবে। ‘রাজনীতির অতিথি পাখি’রা রাজনৈতিক আদর্শের জন্য নয়, বরং নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই দল ত্যাগ করে নতুন দলে যোগ দিয়েছেন। যদি আদর্শের ব্যাপারে তারা ‘কমিটেড’ থাকতেন, তাহলে তো অনেক আগেই তাদের গণফোরাম অথবা বিএনপিতে যোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা তা করেননি। আবু সাইয়িদ কিংবা গোলাম মাওলা রনিরা নতুন দলে (গণফোরাম ও বিএনপি) যোগ দেওয়ার দুদিন আগেও টিভি টক-শোতে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলেছেন। রনির একাধিক বক্তব্য আছে টক-শোতে, যেখানে তিনি বিএনপি ও বিএনপি নেতাদের সমালোচনা করেছেন। এখন রনি বলছেন ‘আমৃত্যু বিএনপির সাথে থাকার কথা’। কিন্তু নির্বাচনের পর তিনি কি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন? ঐক্যফ্রন্ট ও মহাজোটকেন্দ্রিক রাজনীতি এখন জমে উঠেছে। ঐক্যফ্রন্ট থেকে কারা কারা মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করবেন, তা এখন অব্দি নিশ্চিত হয়নি। মহাজোট নিয়েও কথা আছে। মহাজোট শেষ অব্দি টিকে থাকবে কি-না, সেটাও আলোচিত হতে থাকবে বার বার। এর বাইরে তৃতীয় একটি শক্তির উত্থানের কথা বার বার বলা হলেও, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেই সম্ভাবনারও বিকাশ ঘটল না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আবারো প্রমাণ করল জাতীয় রাজনীতি মূলত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে- একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি শক্তি। এতদিন বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। এখন বিএনপির পরিবর্তে সেখানে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জন্ম হয়েছে একটি জোটের, যেখানে বিএনপির একক কর্তৃত্ব আর নেই। তবে রাজনীতিতে আস্থাহীনতা, বিদ্বেষ, অপর পক্ষকে সহ্য না করার যে মানসিকতা, তা রয়ে গেছে। তাতে পরিবর্তন আসেনি। একটি সংলাপ হয়েছিল বটে; কিন্তু তা কোনো ‘ফল’ বয়ে আনেনি। তবে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে একটাই- ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না। অর্থাৎ নির্বাচন বয়কট হচ্ছে না। বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে এবং সবকিছু ঠিক থাকলে আমরা একটি শক্তিশালী বিরোধী দল পাব একাদশ জাতীয় সংসদে। তবে এই নির্বাচন ‘সুবিধাবাদী রাজনীতি’র জন্ম দিয়েছে। রাজনীতিতে ‘অতিথি পাখি’র সংখ্যা বাড়ছে। ব্যবসায়ী ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সরকারি দলে যোগদানের হিড়িক বেড়েছে। সবাই চায় এমপি হতে! এতে করে স্থানীয় নেতৃত্ব উপেক্ষিত থাকছে। অথচ স্থানীয় পর্যায়ে এরাই দলকে টিকিয়ে রাখেন। এখন ‘রাজনীতির অতিথি পাখি’রা, যাদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তারাই দলের মনোনয়ন বাগিয়ে নিচ্ছেন! এতে করে রাজনীতি উন্নত হবে না। স্থানীয় রাজনীতি বিকশিত হবে না। অর্থের জোরে, শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কের জোরে দলীয় মনোনয়ন পেলে এবং নির্বাচিত হলেও, স্থানীয় রাজনীতিতে ও সাধারণ মানুষের জন্য এদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এরা ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে যান। নিজেদের ব্যবসায়ের পরিধি বাড়ান। শুল্কমুক্ত গাড়ি ও প্লট বাগিয়ে নেন। রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ী, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আর সুবিধাবাদীদের কব্জায় চলে যাচ্ছে। এই রাজনীতি গণমানুষের রাজনীতি নয়। এই রাজনীতি দ্বারা তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের উন্নয়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ। দলবদলের এই রাজনীতি কিংবা রাজনীতিবিদরা সম্পত্তির যে হিসাব দিয়েছেন, তাতে করে রাজনীতিবিদদের ওপর আমরা কতটুকু আস্থা রাখতে পারি? এই আস্থার জায়গায় একটি ধস নেমেছে।

ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র বাছাই ও আপিল শুনানির মাধ্যমে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তবে এরা অনেকে যে ঋণখেলাপি, তা তারা জানতেন। জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। তবে প্রশ্ন তো আছেই, যারা কোটি টাকার মালিক, তারা ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করেন না কেন? অনেক রাজনীতিবিদের এই ঋণের খবর অনেকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও তারা সচেতন হননি। ঋণ পরিশোধ করেননি। এখন আইন যদি তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে অনুমতি না দেয়, তাহলে এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে দোষ দেওয়া যাবে না। তারপরও রাজনীতিবিদদের ওপর আমরা আস্থাটা রাখতে চাই। আমরা বার বার রাজনীতিবিদদের কাছে ফিরে যাই। তারাই আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। এ দেশে অনেক রাজনীতিবিদের জন্ম হয়েছে, যারা কোনো সম্পদ রেখে যেতে পারেননি। একজন মওলানা ভাসানীর কথা আমরা সবাই জানি। রাজনীতিবিদরা সৎ হবেন। তারা তাদের কর্মের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন— আমরা তো এমনটাই চাই। কিন্তু ‘অতিথি পাখি’র মতো তারা দলবদল করবেন শুধু মনোনয়ন পাওয়ার আশায় কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করবেন না, এটা আমরা প্রত্যাশা করি না। আস্থাটা তাদের ওপর এখনো রাখতে চাই।

 

লেখক : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads