• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

কাগুজে বাঘ নয় ইসি

  • মোহাম্মদ আবু নোমান
  • প্রকাশিত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮

দুদককে বলা হতো ‘নখ-দন্তহীন বাঘ’! তেমনিভাবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেন ‘নখ-দন্তসম্পন্ন কাগুজে বাঘ না হয়।’ ইসিকে উপলব্ধি করতে হবে যুদ্ধ ময়দানে হয়। সেনানায়করা দূর থেকে তা পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু সাফল্যের স্বাদ কিংবা ব্যর্থতার দায় সেনানায়কদেরই বহন করতে হয়। দেশের সংবিধান অনুসারে নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ। শান্তিপ্রিয় সর্বসাধারণ ইসির যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা ও রণকৌশল দেখতে চায়। নখ-দন্তহীন, তর্জন-গর্জনকারী বাঘ নয়! নখ-দন্তসম্পন্ন কাগুজে বাঘও নয়।

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী সব দলই এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আনন্দের। কিন্তু এখনো সব ব্যাপারে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ ও নিরুদ্বেগ হওয়ার কারণ নেই। এখনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা নিয়ে বিরাজমান দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটেনি। মনে রাখতে হবে, ইসি তথা রাজনীতিকদের কোনো অবিবেচক সিদ্ধান্ত বা ভুলের কারণে যদি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ে, নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যায়, তাহলে দেশ অগণতান্ত্রিক অপশক্তির কবলে পড়তে পারে, নেমে আসতে পারে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়।

বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো কিছুদিন আগেও ঘোষণা দিয়েছিল, নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়- এ শর্তও তাদের ছিল। খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নই আসে না- এ দাবি থেকেও তারা সরে এসেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে বিএনপির যে দাবি-দাওয়া ছিল, সরকার বা নির্বাচন কমিশন কেউ তা পূরণ করেনি। কোনো দাবি না মানা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বিএনপিসহ মহাজোটের বা সরকারের বাইরের সব দলের একধরনের পরাজয় হিসেবে দেখা ভুল হবে। খালেদা জিয়া জেলে, ছেলে নির্বাসনে। প্রায় চার হাজার গায়েবি মামলায় দলটির নেতাকর্মীরা কেউ আটক, পলাতক বা দৌড়ের ওপর। এমতাবস্থায় অবশিষ্ট কর্মীদের ভোটের লড়াইয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার জেদ থাকাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কৌশল থাকবে। কিন্তু এখন থেকে নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ রিটার্নিং, প্রিসাইডিং, পোলিং এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, এসব নিয়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থার বিষয়ে দিকনির্দেশনা জরুরি। একমুখী প্ল্যানিং ও অ্যারেঞ্জমেন্টের নামে নির্বাচনকে যদি বাধ্যবাধকতার আনুষ্ঠানিকতা করা হয়, তাহলে হয়তো সংবিধান রক্ষা হবে, নিয়ম রক্ষা হবে, ক্ষমতা রক্ষা হবে; কিন্তু গণতন্ত্র কি রক্ষা হবে? জনগণের ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার কি রক্ষা হবে? নির্বাচন হয়তো শুধু অংশগ্রহণমূলক হবে। অবাধ হবে কি? এসব প্রশ্নে সর্বসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার শেষ নেই।

দেশের প্রায় সব জেলায় সহিংস ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহিংসতার লক্ষ্য হচ্ছে বিরোধী দল। এসব হামলার পাশাপাশি বাড়ছে হুমকি ও উসকানির ঘটনা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরেও এসব হুমকির বিবরণ ছাপা হচ্ছে। বিরোধীদের ওপর হামলা অব্যাহত থাকলে তারা যদি আত্মরক্ষার জন্যও তা প্রতিরোধের চেষ্টা করে, তাহলে যে রক্তপাত বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। দেশবাসী আর ধ্বংসাত্মক আন্দোলন, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য বা অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা মেনে নেবে না।

বাঙালি হুজুগে জাতি! আমাদের দেশের মানুষ মার্কা দেখে ভোট দেয়, লোকমুখে আছে— হুজুগ উঠলে কলাগাছকেও জেতায়। এর কারণ দেশের বেশিরভাগ মানুষই অশিক্ষিত। এ জন্য সর্বসাধারণকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাল দিয়ে হুজুগে না মেতে দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। শুধু মার্কা নয়, প্রার্থীর যোগ্যতা, দক্ষতা, আচরণ ও সার্বিক বিষয় বিবেচনা করেই ভোট দিতে হবে।

ভুলে গেলে চলবে না, জনগণ এ রাষ্ট্রটির মালিক। ক্ষমতাসীন দল জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আরো দশবার সরকার গড়লেও কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। নির্বাচন-প্রক্রিয়ার একাধিক ধাপ এরই মধ্যে পার হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে সব রাজনৈতিক দল ও জোট। সুতরাং বর্তমান পর্যায়ে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে আশা করা যায়; কিন্তু অবাধ হবে কিনা সেটাই প্রশ্ন? অন্যায় যে করে, অন্যায়ের জায়গা থেকে অন্যায়কে ন্যায়ের পাল্লা দিয়ে মাপাটা অনেক কঠিন। কারণ অন্যায়কারীর কাছে অন্যায়টা বৈধ বলেই বিবেচিত হয়। নির্বাচনকালে অপরিবর্তিত দলীয় সরকার; বহাল থাকা সংসদ; দশ বছর ধরে ক্ষমতাসীন একটি দলের ছায়ায় কমিশনকে কাজ করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় ক্ষমতাহীনরা স্বাভাবিকভাবেই জিততে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তেমনি জিততে চাইবে যারা ক্ষমতায় নেই।

নির্বাচন কমিশনকে বুঝতে হবে, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করায় স্থানীয় প্রভাববলয় সক্রিয় থাকবে। তীব্র আতঙ্ক ও চাপের মুখে থাকবেন রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সব ভোটকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিরোধী দলের কোনো কোনো প্রার্থীও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পেশিশক্তির আশ্রয় নিয়ে থাকবে। এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীদের তৎপরতা যত বেশি হবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ততটাই বাড়বে।

নির্বাচনী প্রচারণায় সব প্রার্থীর অবাধ অংশগ্রহণ ও পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষার পদক্ষেপ নিতে হবে। গায়েবি মামলা, ঢালাও গ্রেফতার আর তল্লাশির আতঙ্কে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-কর্মীদের এলাকা ছাড়া করার পর কীভাবে তাদের সমর্থকরা বিশ্বাস করতে পারবেন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে? নির্বাচন কমিশনকে শক্ত অবস্থানে থেকে সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads