• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

পিএসসি ও জেএসসির ফল এবং শিক্ষার মান প্রসঙ্গে

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ০২ জানুয়ারি ২০১৯

২৪ ডিসেম্বর পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফল একযোগে প্রকাশ করা হয়। এবার জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১ নভেম্বর থেকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে। এতে অংশ নিয়েছিল ২৫ লাখ ৯৯ হাজার ১৬৯ জন শিক্ষার্থী। পিএসসি ও ইবতেদায়ি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৮ থেকে ২৬ নভেম্বরের মধ্যে এবং ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ১২৩ জন পরীক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। এ বছর আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এই সংখ্যা ৬৬ হাজার ১০৮। গত বছর পর্যন্ত জেএসসিতে বিষয় ছিল দশটি, নম্বর ছিল ৯৫০। এবার সাতটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে এবং মোট নম্বর ছিল ৬৫০। এতদিন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখে এসেছিল চতুর্থ বিষয়। কোনো পরীক্ষার্থী একটি বিষয়ে ৮০ শতাংশের কম নম্বর পেলে চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যুক্ত হয়ে সে জিপিএ-৫ পেত। গ্রেডিং পদ্ধতিতে চতুর্থ বিষয়ের জন্য পাঁচ নম্বরের দুই বাদ যেত। বাকি দুই বা তিন যুক্ত হতো মোট জিপিএ-র সঙ্গে। ফলে একজন পরীক্ষার্থীর জিপিএ-৫ পেতে সুবিধা হতো।

প্রতি বছর এসএসসি কিংবা এইচএসসি স্তরে ১০ থেকে ১৩ লাখ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এই পরীক্ষা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়টি শিক্ষা বোর্ড আছে। এ ছাড়া মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষার জন্য রয়েছে আলাদা আরো দুটি বোর্ড। প্রাথমিক পরীক্ষায় সারা দেশে এ দুটি পরীক্ষায় প্রায় তিনগুণ শিক্ষার্থী অংশ নেয় অথচ নেই আলাদা কোনো শিক্ষা বোর্ড। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পরিচালনা করা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। এই পর্যায়ে কোনো আলাদা বোর্ড না থাকায় সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল প্রদানসহ পরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। প্রতি বছরের শেষ দুটি মাস শিক্ষা কর্মকর্তারা বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ ও প্রতিটি বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার টার্গেট অনুযায়ী ভর্তি কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকেন। একই সময় এই পরীক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়।

প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিধি দিন দিনই বাড়ছে। অধিদফতর ও পরিদফতরের মাধ্যমে এ দুটি পর্যায়ের  শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং পাঠ্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব অধিদফতর ও পরিদফতরের। পাঠ্যক্রম তৈরি, পরীক্ষা পরিচালনা ও সনদ বিতরণ তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড’ গঠনের বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের সবচেয়ে বড় এই পাবলিক পরীক্ষার ফল তৈরিতেও গত দুই বছরে অনিয়মের  ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার উত্তরপত্র সংশ্লিষ্ট জেলায় পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ফলাফলের তালিকা তৈরি হয় উপজেলা শিক্ষা অফিসে। তবে বৃত্তি পাওয়ার আশায় ভালো ফলের জন্য উত্তরপত্রে নম্বর বেশি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গত দুই বছর পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর। তবে এ বছর এক উপজেলার খাতা অন্য উপজেলায় মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি প্রশংসার পদক্ষেপ বলতে হবে।

গত বছরের তুলনায় এ বছর অনুপস্থিতির সংখ্যা বেড়েছে। এটি শুভ লক্ষণ নয়। দেশ উন্নত হচ্ছে, শিক্ষায় জোর দেওয়া হচ্ছে তবু কেন অকালে ঝরে পড়ছে এত শিক্ষার্থী? পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করতে পারার পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ বাল্যবিয়ে ও দারিদ্র্যের শিকার। বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি এখনো সমাজ থেকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি, যা আমাদের চরম ব্যর্থতা। অষ্টম শ্রেণি অতিক্রম করার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অনেকের। গত বছর জেএসসি ও জেডিসিতে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির ওপর জরিপ করেছিল সরকার। জরিপ বলছে, শুধু বাল্যবিয়ের কারণে এক বছরে ঝরে পড়েছে পাঁচ হাজার ছাত্রী। দেশে সার্বিকভাবে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটলেও এখনো বড় প্রতিবন্ধকতা বাল্যবিয়ে। সরকারিভাবে লেখাপড়ার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলেও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও অসচেতনতার কারণে এটি পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাল্যবিয়ে রোধে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তবু চোখের অন্তরালে বাল্যবিয়ে চলছেই। ইউনিসেফ তাদের এক জরিপে বলেছে, বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। বাল্যবিয়ের বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে ওই জরিপে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, সামাজিক চাপ, নিরাপত্তার অভাব, অসচেতনতা এবং বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার।

২০১৭ থেকেই জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, কর্মমুখী শিক্ষা এবং চারু ও কারুকলা বিষয় ধারাবাহিক মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়। এবার থেকে চতুর্থ বিষয় কৃষি শিক্ষা ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞানকেও স্কুলের মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়। এর অর্থ হচ্ছে এ বিষয়গুলো বিদ্যালয়েই মূল্যায়ন করা হবে, এগুলোর ওপর কোনো পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। এছাড়া এতদিন ৮৫০ নম্বরের পরীক্ষা হলেও এবার থেকে বাংলায় দুই পত্র থেকে ৫০, ইংরেজি দুই পত্র থেকে ৫০ এবং চতুর্থ বিষয় থেকে ১০০ নম্বর বাদ দেওয়া হয় অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ৬৫০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে।। এতে পাসের হার বাড়লেও জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে কিছুট বিপর্যয় ঘটে। এবার জেএসসি ও জেডিসিতে পাস করে ২২ লাখ ৩০ হাজার ৮২৯ জন শিক্ষার্থী অর্থাৎ পাসের হার ৮৫.৮৩ শতাংশ। গত বছর এই হার ছিল ৮৩.৬৫ শতাংশ। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৮ হাজার ৯৫ জন, গত বছর পেয়েছিল ৯১ হাজার ৬২৮ জন। পিইসি পরীক্ষায় এবার ২৫ লাখ ৮৮ হাজার ৯০৪ জন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। পাসের হার ৯৭.৫৯ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ১৯৩ জন। গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে ২.৪১ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ বেড়েছে এক লাখ ৫ হাজার ৫৮৪ জন। ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় মোট ২ লাখ ৭৪ হাজার ৯০৭ পরীক্ষার্থীর মধ্যে সব বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৭ জন। পাসের হার ৯৭.৬৯ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ হাজার ২৬৪ জন। গত বছরের তুলনায় পাসের হার বেড়েছে ৪.৭৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ বেড়েছে ৭ হাজার

২৪১ জন।

পরীক্ষায় অংশগ্রহণের হার, সাফল্যের হার, জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার— এ সবগুলো নির্দেশকেই মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে। এটি নিশ্চয়ই একটি পজিটিভ দিক। মেয়েদের অংশগ্রহণের হার এবং গ্রেড প্রাপ্তিতে এগিয়ে থাকলেও গত ক’বছরে জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে ছিল যা এবার টপকে গেছে। ইবতেদায়ি ও জেডিসিতেও মেয়েরা এগিয়ে। মেয়েদের পাসের হার ৮৯.৭৯ শতাংশ এবং ছেলেদের ৮৮.০১ শতাংশ। ১ হাজার ২৯ মেয়ে এবং ৯৫৮ ছেলে জিপিএ-৫ পেয়েছে। জেডিসিতে এবার পাসের হার ৮৯.০৪ শতাংশ যা গতবার ছিল ৮৬.৮০ শতাংশ। ইবতেদায়িতে পাসের হার ৯৭.৬৯ শতাংশ, গত বছর এই হার ছিল ৯২.৯৪ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ হাজার ২৬৪ জন। ২০১৭ সালে ছিল ৫ হাজার ২৩ জন।

সার্বিকভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি হয়েছে এবং সরকার শিক্ষার উন্নয়নে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিক্ষাক্ষেত্রে এখনো অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে চলেছে, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘিরে রেখেছে। এ থেকে যে কোনো মূল্যে আমাদের পরিত্রাণ পেতে হবে। কেননা একটি দেশের ধারাবাহিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ ও মান নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

 

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads