• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

প্রচণ্ড চাপের মুখে জাতীয় অর্থনীতি

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বেড়ে চলা সঙ্কটের মধ্যেও জাতীয় অর্থনীতি সম্প্রতি প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েছে জাতীয় অর্থনীতি। জনগণের ‘কোমর’ও ভেঙে পড়ার পর্যায়ে এসে গেছে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য প্রথমে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত কয়েকটি তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করা যাক। বিগত কয়েকদিনে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে অর্থ কেলেঙ্কারি এবং লোপাট সংক্রান্ত কিছু খবর। সিপিডিসহ একাধিক গবেষণা সংস্থার উপস্থাপিত তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে এসব রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত দশ বছরে মাত্র দশটি কেলেঙ্কারিতেই লোপাট হয়ে গেছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা! কেলেঙ্কারিগুলো হয়েছেও আবার ব্যাংকিং খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে বিশেষ কয়েকটি ব্যাংকের নাম রয়েছে রিপোর্টে। কোন ব্যাংক থেকে কত শত বা হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও জানতে পেরেছে মানুষ। কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের নামও উল্লেখ করা হয়েছে, শিল্প ও বাণিজ্যের নামে যে গ্রুপগুলোর মালিকরা টাকা লোপাটের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ পর্যন্ত এসে পাঠকরা তাই বলে ভাববেন না যে, লোপাট হয়ে যাওয়া সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকাই আজকের বিষয়বস্তু। উদ্দেশ্য আসলে দেশের ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা। ‘কোমর’ ভেঙে দেওয়া বিষয়ক প্রবাদ ও এর মূলকথা সম্পর্কে পাঠকদের নিশ্চয়ই ধারণা রয়েছে। কোনো মানুষের কোমর ভেঙে দেওয়া হলে তার পক্ষে আর সোজা হয়ে দাঁড়ানো এবং চলা-ফেরা করা সম্ভব হয় না। যে কোনো দেশ ও জাতির ক্ষেত্রেও কথাটা সমানভাবে প্রযোজ্য। একটি দেশকে দুর্বল ও পর্যায়ক্রমে ধ্বংস করতে হলে প্রথমে তার কোমর ভেঙে ফেলতে হয়। আর কোনো দেশের কোমর বলতে দেশটির অর্থনীতিকেই বোঝানো হয়। কোনো একটি বা কয়েকটি বিদেশি শক্তি যদি বাংলাদেশকে দুর্বল বা বিপন্ন করতে চায়, তাহলে প্রথমেই দেশটি এবং দেশগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টার্গেট করবে। দেশের অভ্যন্তরের কোনো একটি কিংবা কয়েকটি শক্তিও যদি একক বা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি করতে চায় এবং দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে চায়, তাহলেও প্রথমে আক্রান্ত হবে দেশের অর্থনীতিই। এই অর্থনীতি বলতে আবার কেবলই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমদানি-রফতানি বোঝায় না; বরং যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে দেশটির ব্যাংকিং খাত। ভীতি ও আশঙ্কার কারণ হলো, বাংলাদেশে সে ব্যাংকিং খাতই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বলা চলে, সুচিন্তিতভাবে ব্যাংকিং খাতকে চূড়ান্ত সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এখনো ঠেলে দেওয়ার কর্মকাণ্ড অব্যাহত

রয়েছে। একই কারণে দেশের ‘কোমর’ ভেঙে যাওয়ার প্রসঙ্গ না তুলে পারা যায়নি।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে বহুদিন ধরেই। বলা হচ্ছে, সরকারের ভুল নীতি এবং দলীয় বিবেচনার কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদসহ তথ্যাভিজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে নীতিতে সংশোধন করার এবং বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ব্যাংকিং খাতই শুধু ধ্বংস হয়ে যাবে না, জাতীয় অর্থনীতিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 এমন অবস্থার কারণ জানাতে গিয়ে বলা হয়েছে, একদিকে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও একের পর এক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে সরকার, অন্যদিকে সরকারের অঘোষিত সহযোগিতায় একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী পুঁজি বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে পরিবর্তন করার এবং নিজেরা পরিচালক হওয়ার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ঋণখেলাপি ও অসৎ ব্যবসায়ীরাও। লক্ষ্য হাসিলে তারা অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। সে কারণেই ভীত ও আতংকিত হয়ে পড়া সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংকগুলো থেকে তাদের সঞ্চয়ের অর্থ উঠিয়ে নেওয়ার পথে পা বাড়িয়েছেন। অথচ এই ব্যাংকগুলো বহু বছর ধরে দেশের জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি করেছিল। সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশেও ব্যাংকগুলোর ছিল বিপুল অবদান। অন্যদিকে সুচিন্তিত আক্রমণের শিকার হওয়ার পর সে ব্যাংকগুলোই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

সরকারের অন্যকিছু সিদ্ধান্তের পরিণতিতেও দেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রাধান্যে এসেছে নতুন কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও সরকার নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে রাজনৈতিক বিবেচনা। কিন্তু দেশের অর্থনীতির আকার ও পুঁজিবাজারের পরিসর অত্যন্ত সীমিত হওয়ার কারণে এসব ব্যাংক মোটেও সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। কোনো কোনো ব্যাংক বরং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই লোকসান গোনার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে উঠেছে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য ফারমার্স ব্যাংকের কথা বলা যেতে পারে। ব্যাংকটি সূচনাকাল থেকেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়েছিল যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া ৩০০ কোটি টাকার বিশেষ সাহায্য নিয়েও ফারমার্স ব্যাংক তার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠাকালে ঋণসহ কৃষকদের সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যের ঘোষণা দিলেও ফারমার্স ব্যাংকের কাছ থেকে কৃষকরা কোনো সহায়তা পায়নি। ২০১৭ সালের শেষদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন ঘটলেও ফারমার্স ব্যাংকের পক্ষে আর লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ এর অর্থের লুণ্ঠন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের কোনো অর্থই আর ফেরত পাওয়া যাবে না।

অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গলদ ছিল আসলে এসব ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্যেই। কারণ অত্যন্ত সীমিত অর্থনীতির বাংলাদেশে এত বেশিসংখ্যক ব্যাংকের লাভজনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল না, এখনো নেই। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদে অর্থনীতির একটি দেশে এত বেশিসংখ্যক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাভজনক হওয়া এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কিছুদিন আগে আরো তিনটি নতুন ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রতিটি ব্যাংকের সঙ্গেই দেশের রাজনৈতিক রাঘব-বোয়ালরা জড়িত রয়েছেন। 

বলা হচ্ছে, সরকারের এই ভুল নীতি এবং সিদ্ধান্তের কারণেই দেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। লোপাট হয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। লোপাট হচ্ছে এখনো। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়ার পরিবর্তে সরকারের উচিত ছিল বিদ্যমান ব্যাংকগুলোকে বিপর্যয়ের কবল থেকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে তৎপর হয়ে ওঠা। তেমন পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এবং ঋণ ও বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠনের বাধাহীন কারবারকে চলতে দেওয়া হলে একদিকে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই বিপর্যয় কাটিয়ে লাভজনক হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না; অন্যদিকে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে দেশের ব্যাংকিং খাত। আর ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হওয়ার অর্থই হলো দেশ ও জাতির ‘কোমর’ ভেঙে যাওয়া।

এখানে খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। কারণ এ বিষয়ে এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও সর্বশেষ সঠিক তথ্য নেই বলে ধারণা করা হয়। জানা গেছে, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রয়েছে অবলোপনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার মন্দ ঋণকে আড়াল করে ফেলার অপতৎপরতা। প্রকাশিত সব রিপোর্টেই বলা হয়েছে, আইন ও নিয়ম না মেনে বিশেষ করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেওয়ার ফলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ এভাবে বেড়ে গেছে। ঋণের অর্থ নির্ধারিত সময়ে ফেরত না দিলে যেহেতু কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, সে কারণেও ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।

এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংকের প্রতিটিই কমবেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। এভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ব্যাংকিং ইতিহাসে এক ‘বিরল’ ও ‘অস্বাভাবিক বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, অবস্থার পরিবর্তন না ঘটানো হলে দেশের ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে। বাস্তবে এরই মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছেও। দেশের ব্যাংকিং খাত আর কখনো সহজে ‘কোমর’ সোজা করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি নিয়ে সংসদ নির্বাচনের পরও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সরকারের পক্ষ থেকে বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় কি-না।

 

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads