• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

গণতন্ত্র একটি প্রায়োগিক মতবাদ

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

নতুন বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাপ্তাহিক পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্টের গবেষণা বিভাগ ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ইআইইউর তথ্যমতে, এবার বাংলাদেশ গণতন্ত্র সূচকে গত বছরের তুলনায় ০.১৪ স্কোর বেশি পেয়ে চার ধাপ এগিয়েছে। প্রতিবেদন মতে, ৫ দশমিক ৫৭ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ১৬৫টি দেশের মধ্যে ৮৮তম স্থানে অবস্থান করছে। গত বছর এ স্কোর ছিল ৫ দশমিক ৪৩ এবং দেশের অবস্থান ছিল ৯২তম। এ বছরের সূচকে বলা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কা বাদে আর বাকি দেশগুলোর— ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মিয়ানমার— চাইতে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। ইআইইউ ২০১৮ সালে দেশের গণতন্ত্রের পাঁচটি বিষয়ের ওপর নিরীক্ষণ চালিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চার ধাপ এগিয়েছে বলে জানায়। ইআইইউ যে পাঁচটি বিষয়ের ওপর গবেষণা চালিয়েছে তা হচ্ছে- নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারের সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে যে মত দিচ্ছে, সেটার সত্যতা যাচাইয়ের মানদণ্ড এদেশের সাধারণ জনগণ। একটি গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকদের যে ধরনের অধিকার পাওয়ার কথা, বাংলাদেশে তা পাচ্ছে কি না সেটা আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চাইতে এদেশের মানুষ অধিক জ্ঞাত। একটি দেশে গণতান্ত্রিক শাসন আছে কি না তা যাচাইয়ের জন্য যে সব বিষয় উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, সে মানদণ্ডগুলো বিবেচনায় নিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থান মূল্যায়নের জন্য আমাদের দেশের জনগণের মত-ই হচ্ছে চূড়ান্ত। এবং প্রাপ্ত ফলের ভিত্তিতে তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই হবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক কি না তার প্রমাণ।

গণতন্ত্র একটি প্রায়োগিক মতবাদ। কোনো দেশে গণতান্ত্রিক শাসন আছে কি নেই, সেটা যাচাইয়ের জন্য গবেষকরা দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। প্রথমটি াবৎঃরপধষ ধপপড়ঁহঃধনরষরঃু। দ্বিতীয়টি হচ্ছে যড়ৎরুড়হঃধষ ধপপড়ঁহঃধনরষরঃু। প্রথমোক্ত পদ্ধতির সঙ্গে গণমানুষের প্রতিনিধিত্বের বিষয় জড়িত। প্রতিনিধিত্বশীল পদ্ধতিতে দেখা হয় নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলো, নির্বাচনের ত্রুটির ব্যাপারে সমস্যা মুক্তির পরিমাণ নির্ধারণ এবং এর ওপর ভিত্তি করে বিরাজমান গণতন্ত্রের মান নির্ণয় করা হয়। আরো দেখা হয়, সময়মতো নির্বাচন হচ্ছে কি না, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে কি না, সর্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত হয় কি না, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু, মানুষ নির্বিঘ্নে সংগঠিত হতে পারে কি না, নাগরিকরা স্বাধীনভাবে পছন্দ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারে কি না, সব রাজনৈতিক দল স্বীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অবাধে পালন করে করতে পারে কি না এবং তাদের রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো প্রচার কতটা বাধাহীন, বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে কি না ইত্যাকার বিষয়, যা একটি গণতান্ত্রিক দেশে নতুন সংসদ গঠনের জন্য অপরিহার্য। এরপর যড়ৎরুড়হঃধষ পপড়ঁহঃধনরষরঃু মানদণ্ডে দেখা হয় একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনায় গণতন্ত্রের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ। এখানে বিবেচ্য বিষয়গুলো হচ্ছে— রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন কি না, প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ, সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করে কি না, শাসকশ্রেণির পক্ষ থেকে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ জনগণ রাষ্ট্র প্রদত্ত সেবা উপযুক্তভাবে পায় কি না, সব নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার উন্মুক্ত কি না, শাসকশ্রেণি সামাজিক সমতা ও মানবিক সমর্যাদায় গুরুত্ব দেয় কি না, জাতিগতভাবে সব সংখ্যালঘু শ্রেণির প্রতি সরকার যথোপযুক্ত দায়িত্বশীল কি না ইত্যাকার বিষয়। উপর্যুক্ত  বিষয়গুলো সরকার গঠনের পরে বিবেচ্য। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল গণতান্ত্রিক কি না তা প্রমাণিত হয়। এবং গণতান্ত্রিক শাসক যাচাইয়ের উল্লেখিত পদ্ধতি দুটির আলোকে এটাও প্রমাণিত হয় যে দেশটি গণতান্ত্রিক কি না।

ইআইইউর ভাষ্যমতে পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে দেশে নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। এবং এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি থাকবে যাতে গণতান্ত্রিক নীতিগুলো বিকাশ পায়, গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্ণ চর্চা থাকে। পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপাদানগুলো হচ্ছে— স্বাধীন বিচার বিভাগ, সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য ও পূর্ণ জবাবদিহিতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্য। ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র হচ্ছে, যেখানে কিছু কিছু ব্যতিক্রম বাদে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, শাসকশ্রেণি নাগরিক অধিকারে সম্মান দেখায় ও রক্ষা করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি অবিকশিত এবং শাসনব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। হাইব্রিড রেজিমে নির্বাচন পদ্ধতিতে ত্রুটি থাকার ফলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এখানে নির্বাচন হয় লোক দেখানোর জন্য। ক্ষেত্রবিশেষে সুষ্ঠু হলেও রাজনৈতিক দলগুলো ফল নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না। সরকারি দল নির্বাচনী ফল অনুকূলে আনার জন্য সবসময় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতা করতলগত করে রাখতে চায়। যার ফলে বিরোধী দলগুলোর ওপর অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক নিপীড়ন চালায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই, থাকলেও সীমিত। দেশের সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি বিদ্যমান। শাসকশ্রেণি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে হয়রানি ও নির্যাতন করে এবং সবসময় চাপে রাখে। সরকারের সমালোচনা সহ্যক্ষমতা কম থাকে। অনেক সময় গণমাধ্যম ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করে। হাইব্রিড রেজিমে সিভিল সোসাইটিকে দুর্বল করে রাখা হয়। তাদের প্রতি সরকারের রোষ থাকে। শাসকশ্রেণি নাগরিক অধিকারে সম্মান দেখায় না এবং বিভিন্ন অজুহাতে হস্তক্ষেপ করে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো দলীয়করণ হয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃত্ববাদী আচরণ করে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসন হচ্ছে, যেখানে বহুদলের রাজনীতি অনুপস্থিত। রাষ্ট্র পরিচালনা হয় রাজতান্ত্রিক নিয়মে বা একনায়কের অধীনে। ক্ষেত্রবিশেষে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা নামমাত্র। শাসকশ্রেণি কর্তৃক দেশের নিরাপত্তার দোহাই বা উন্নয়নের নামে ইচ্ছামতো নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা একটা সাধারণ ব্যাপার। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকে না। নির্বাচন হয় না, যদিও বা হয় তা লোকদেখানো মাত্র। গণমাধ্যম থাকে কড়া নিয়ন্ত্রণে। সরকার সমালোচনা সহ্য করে না।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads