• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং আগরতলা মামলা প্রসঙ্গ

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

‘কারাগারের রোজনামচা’ একটি গ্রন্থের নাম। লেখক শেখ মুজিবুর রহমান। ২০১৭ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো বাংলা একাডেমি প্রকাশিত গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং লেখকের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান নেতা এবং বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিব সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। ব্রিটিশ ভারতে কলকাতাকেন্দ্রিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে রাজনীতি শুরু করলেও একজন সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন ১৯৪৭ সালের আগস্টে গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানে।

মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। প্রথম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ বিরোধী প্রগতিশীল যুবনেতা শামসুল হককে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৫৩ সালের এপ্রিল অধিবেশনে শেখ মুজিব দলের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের ওই অধিবেশনেই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব বাংলার জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে প্রাধান্যে আনা হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার ‘রূপমহল’ সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পূর্ণাঙ্গ কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পরিবর্তিত নাম রাখা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তখন থেকেই শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন এগিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন। পর্যায়ক্রমিক সে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘পশ্চিম পাকিস্তানের’ রাজধানী লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে তিনি তার ৬ দফা উপস্থাপন করেছিলেন।

একযোগে শুরু হয়েছিল তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাকে গ্রেফতারের অভিযান। ৬ দফার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভায় ভাষণ দিয়ে বেড়িয়েছেন শেখ মুজিব। প্রায় প্রতিটি উপলক্ষেই মামলা যেমন দায়ের করা হয়েছে, তেমনি কারাগারেও ঢোকানো হয়েছে তাকে। তিনিও আদালতের মাধ্যমে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। মামলা-গ্রেফতার-জামিন এবং আবারো মামলা— এভাবেই চলেছে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। তাকে শেষবারের মতো গ্রেফতার করা হয়েছিল সে বছরের ৯ মে। এরপর আর জামিন পাননি তিনি। তাকে বরং নতুন ধরনের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনি এমনকি দণ্ডিতও হয়েছেন।

‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের শুরুটাও এ সময় থেকেই করেছেন শেখ মুজিব। তাই বলে এমন মনে করা ঠিক নয় যে, ১৯৬৬ সালেই তার কারাজীবনের শুরু হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথমবার গ্রেফতার করা হয় তাকে। ১৫ মার্চ মুক্তি দেওয়া হলেও ১৯৪৮ সালেরই ১১ সেপ্টেম্বর আবারো কারাগারে যেতে হয় তাকে। এবার মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯ এপ্রিল গ্রেফতার হয়ে জুলাই মাসে মুক্তি পাওয়ার পর খাদ্যের দাবিতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ভুখা মিছিলে অংশ নেওয়ার কারণে আবারো গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর। এবার মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভূমিকায় গ্রেফতার ও মুক্তির বিষয়ে সন ও তারিখসহ উল্লেখ করেছেন ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে।

রাজনৈতিক জীবনের প্রাথমিক দিনগুলো থেকে এভাবেই বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কারাগারকে ‘একটা আলাদা দুনিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করে ‘কারাগারের রোজনামচা’র প্রথম অধ্যায়ে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘আমি পাঁচবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সব ধরনের কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি। আমার জীবনে কী ঘটেছে তা লিখতে চাই না, তবে জেলে কয়েদিরা কীভাবে দিন কাটায়, সেইটাই আলোচনা করবো।’ (পৃষ্ঠা- ২৭)

বাস্তবেও অন্যদের কথাই বেশি লিখেছেন শেখ মুজিব। অনেক কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ও তথ্যও রয়েছে ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে। কিন্তু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র মতো এ গ্রন্থটি পড়তে গিয়েও মনে পড়ে যাবে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। কারণ ১৯৬৬ সালের জুন মাসের ঘটনা দিয়ে শুরু করলেও শেখ মুজিব হঠাৎই ‘শেষ’ করেছেন ১৯৬৭ সালের ২২ জুন। কেন— তার কারণ জানতে হলে ইতিহাস সম্পর্কে যেমন ভাবতে হবে তেমনি সত্য জানার জন্য অপেক্ষাও করতে হবে। রাজনৈতিক ইতিহাসের ছাত্র এবং গবেষক হিসেবে আমি অবশ্য সংগ্রামী এই নেতাকে সশ্রদ্ধচিত্তে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ এদেশের খুব কমসংখ্যক রাজনীতিকই তাদের জীবনী লিখে গেছেন। বিশেষ করে কারাগারের অভিজ্ঞতা তেমন কেউ লেখেননি বললেই চলে।

সেদিক থেকে শেখ মুজিব অবশ্যই প্রশংসনীয় কাজ করে গেছেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃতিত্ব দিয়েছেন তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে। কারণ যতবার নেতা জেলে গেছেন, ততবারই বেগম মুজিব শুধু লেখার জন্য খাতাই পৌঁছে দেননি, লেখার জন্য তাগিদও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুরু করেন। যতবার জেলে গেছেন আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌঁছে দিতেন। আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন

খাতাগুলি সংগ্রহ করে নিজে সযত্নে রেখে দিতেন। তার এই দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকত তাহলে এই মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে দিতে পারতাম না। বার বার মায়ের কথাই মনে পড়ছে।’ (পৃষ্ঠা-১৬)  

শেখ মুজিব সম্পর্কিত যে কোনো আলোচনায় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এসে যায় একটি প্রধান বিষয় হিসেবে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পর্যন্ত লিখলেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রসঙ্গে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ মুজিব তেমন কিছু লিখতে পারেননি। এর কারণ, ১৯৬৬ সালের ৯ মে থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি গভীর রাতে হঠাৎ করেই তাকে ‘মুক্তি’ দেওয়া হয়। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের ওই দিনগুলোতেও দেশের সব কারাগারে কিছু বিধি ও নিয়ম মানা হতো। এসবের মধ্যে একটি ছিল রাতে মুক্তি না দেওয়া। আদালত থেকে আদেশ এলেও বিকাল পাঁচটা বেজে গেলে সংশ্লিষ্ট বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হতো পরদিন সকাল দশটার পর।

কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছিল শেখ মুজিবের ক্ষেত্রে। তিনি আপত্তি জানালেও জেল কর্তৃপক্ষ মুক্তি দেওয়ার নাম করে তাকে ডেপুটি জেলরের অফিস কক্ষে নিয়ে গিয়েছিল। ওই অফিসে যাওয়ার পরই শেখ মুজিবের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়েছিল। সেখানে

আগে থেকে অপেক্ষা করছিল সেনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানরা। তারা গিয়েছিল শেখ মুজিবকে নতুন এক মামলায় গ্রেফতার করার জন্য।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ মুজিব লিখেছেন, “আমি ডেপুটি জেলর সাহেবের রুমে এসে বসতেই একজন সামরিক বাহিনীর বড় কর্মকর্তা আমার কাছে এসে বললেন, ‘শেখ সাহেব, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো।’ আমি তাকে বললাম, নিশ্চয়ই আপনার কাছে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আছে। আমাকে দেখালে বাধিত হব। তিনি একজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারীকে বললেন পড়ে শোনাতে। তিনি পড়লেন, ‘আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলো।’ আমি বললাম, ঠিক আছে, চলুন কোথায় যেতে হবে। সামরিক বাহিনীর কর্মচারী বললেন, কোনো চিন্তা করবেন না, আপনার মালপত্র আপনি যেখানে থাকবেন সেখানে পৌঁছে যাবে।”

সামরিক বাহিনীর ওই কর্মকর্তার সঙ্গে জেলের বাইরে এসে শেখ মুজিব দেখেছিলেন একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এবং চারদিকে সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা পাহারায় রয়েছে। একজন মেজর তাকে গাড়িতে উঠতে বললেন। তিনি উঠলেন। তার দুই পাশে বসলো দুজন সশস্ত্র সৈনিক। এরপর শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘গাড়ি নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে রমনার দিকে চলল।... ভাবলাম, কোথায় আমার নূতন আস্তানা হবে। কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুই তো জানি না। গাড়ি চলল কুর্মিটোলার দিকে।...’ বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতার এই বিশদ ঘটনা এক সংখ্যায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আগামী সংখ্যায় লেখার ইচ্ছা রইল।

 

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads