• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আর কত রক্ত চায় যন্ত্রদানব কত চায় কান্নার লোনা জল

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অনুজপ্রতিম সহকর্মী ফাইজুল ইসলাম শোকে বেদনায় মুহ্যমান। কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী ও দুর্বহ বোঝা আজ ওর কাঁধে। চোখের সামনে, এক পলকের ব্যবধানে বদলে গেল স্বপ্নেভরা পৃথিবীর রঙ। ঘাতক যন্ত্রদানব চাকার তলে পিষে মেরেছে আমার ভাইয়ের নিষ্পাপ শিশুকন্যাকে। গত মঙ্গলবার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে যাওয়ার পথে, ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়েটি, হারিয়ে গেল। বেপরোয়া এক মাইক্রোবাস কেড়ে নিয়েছে শিশুটির জীবন। খবর পেলাম, মেয়েটি হাত ধরে ছিল সাবধানী পিতার। কিন্তু রাস্তা পার হতে নেমে ও বলল, বাবা আমি একাই পার হতে পারব। আহ! পিতার হাত ছেড়ে চঞ্চলা মেয়েটি একা রাস্তা প্রায় পার হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ আজরাইলের দূত ধাবমান এক মাইক্রো এসে মেয়েটিকে পার হতে দিল না। ওর তাজা-তপ্ত রক্তে ভাসল রাজপথ, চোখের পলকে বাবা ও মায়ের লালিত স্বপ্নের পাণ্ডুলিপিতে আঁকা হয়ে গেল রক্তের আল্পনা।

আজ (গতকাল) সকালে যখন লেখাটি লিখছি, তখন কেবলই চোখের সামনে ভেসে উঠছে ফাইজুল আর ওর স্ত্রী নার্গিসের বেদনাভারাক্রান্ত মুখ। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফুটফুটে মেয়েটি, ফাইজুলের আত্মজা সূচির মুখটি। সূচি আমার খুব চেনা। ওকে দেখেছি কতবার। যমুনার পাড়ে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের পিকনিকে গিয়েছিল সূচি সপরিবারে। সঙ্গে ছিল ওর ছোট ভাইটিও। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কেও ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সূচি আর ওর ছোট ভাইটিকে নিয়ে ফুলের বাগানে ছবিও তোলা হয়েছিল। সেই ছবি আছে আমার ফেসবুকে। ছবি তোলা হয়েছিল সেই বিকেলে যমুনার তীরেও, সূর্য তখন অস্তাচলগামী। ফাইজুলের বুকভরা স্বপ্ন ছিল দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে। ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ফাইজুলকে দেখেছি সবসময় খুব সাবধানী, খুব মিতব্যয়ী জীবনাচারে অভ্যস্ত হতে। উত্তরায় রাজউকের একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছে ফাইজুল। গত জানুয়ারিতেই সেই ফ্ল্যাটে ওঠার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী ছেলেমেয়েকে ভর্তি করিয়েছে মাইলস্টোন স্কুলে। কিন্তু রাজউক কথা রাখেনি। ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে পারেনি সময়মতো। তারপর বলেছে জুনে দেবে, তাও দিতে পারেনি। নিজের ফ্ল্যাটে উঠবে বলে মিরপুরের ভাড়া বাসা ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল ফাইজুল। আর এখন ওর মেয়েটিই হারিয়ে গেল! আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করি, সন্তান বিয়োগের এই কঠিন ভার বহন করার শক্তি দিন অশ্রুসজল মা ও বাবাকে।

ফাইজুলকে খুব কাছ থেকে চিনি বলে, ওর মনের ওপর দিয়ে কী ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিবাত্যা বয়ে চলেছে, তা কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারি। এভাবে এই দেশে প্রতিদিন রাজপথে ঝরে চলেছে কত রক্ত! কত নারী ও পুরুষের, শিশু ও বৃদ্ধের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে বেসামাল যন্ত্রদানব, তার কোনো লেখাজোখা নেই। কত মায়ের কোল খালি হয়ে যাচ্ছে, কত পিতা বয়ে বেড়াচ্ছেন সন্তান হারানোর দুর্বিষহ বেদনাভার, তার হিসাব সত্যিই কি দিতে পারে কোনো  পরিসংখ্যান! ঘণ্টায় ঘণ্টায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে রাজপথে মৃত্যুর মিছিল। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার নেই। সড়ক দুর্ঘটনা রুখে দেওয়ার কোনো পথ এখনো খুঁজে পাওয়া গেল না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে আইন হয়েছে, কঠোর থেকে কঠোরতর। সংস্কার হয়েছে বার বার। রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী রোড অ্যাকসিডেন্টে জীবন দিয়ে স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের জাগিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার্থীর ইউনিফর্ম পরে রাস্তায় নেমে এসেছিল ওরা। রাজপথে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্যে আমাদের সন্তানরা ততোধিক সুশৃঙ্খল আন্দোলনে নেমেছিল। মুগ্ধ-বিস্ময়ে দেশের মানুষ ও বিশ্বসমাজ দেখেছে সেই অভূতপূর্ব সংগ্রাম। বড় ও বুড়োরা সেদিন আহ্লাদ করে বলেছেন,  আমরা যা পারিনি এবং পারি না, আমাদের ছেলেমেয়েরা সেটা করে দেখাচ্ছে। তা দেখিয়েছে বটে! কিন্তু তা থেকে কী শিখেছি আমরা, কী শিখেছেন চালক, যাত্রী, আইনপ্রণেতা ও প্রয়োগকারীরা? যদি বলি, কেউ কিছু শেখেনি, তাহলে কি খুব বেশি বলা হবে? 

শুধু বইয়ে লেখা আইন কি পারে অনাচার রুখে দিতে, রাজপথে কিংবা দেশ-কালের অন্য কোনো স্তরে? পারে না? পারে না। পারে যে না, তার ভূরিভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমরা দক্ষতার কথা বলি, প্রফেশনালিজমের কথা বলি। কিন্তু দক্ষতা কাকে বলে, পেশাদারিত্ব কাকে বলে, সেটাই তো আমরা ভুলে গেছি। সমাজের কোথায়, কোন জায়গাটিতে আজ সত্যিকারের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়? কোথায় হারিয়ে গেল পেশাদারিত্বের দাবি! যারা মাইক্রো চালায়, বাস চালায়, ট্রাক চালায়- তারা পেশাদার কাণ্ডারি। যারা নিজের গাড়ি নিজে চালান, তাদের পেশাদার ড্রাইভার বলা যাবে না। যদিও তাদেরও দক্ষতার সার্টিফিকেট থাকা আবশ্যক।

এই দক্ষতার লাইসেন্স দেওয়ার আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে। সেই কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লাইসেন্স দেয়। এবং যখন কেউ লাইসেন্স বাগিয়ে নিতে পারেন, তখন আইনত তাকে অদক্ষ বলার সুযোগ নেই। কিন্তু লাইসেন্সধারী ড্রাইভারদের অনেকেই রাজপথে চাকায় পিষে মানুষ মারছে। দুর্ঘটনায় পড়ে যাত্রীদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে। এগুলো কি দক্ষতার পরিচয় বহন করে? এসব দুর্ঘটনা এও প্রমাণ করে যে, কেবল পুঁথিগত আইন দিয়ে রাজপথে অনাচার রোধ করা যায় না। এ জন্যে আইন যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন আইন মান্য করার প্রায়োগিক শিক্ষা ও সচেতনতা এবং প্রায়োগিক সততা।

একজন গাড়ি চালাতে পারেন, গাড়ির স্পেয়ারপার্টস চেনেন— এ জন্য তিনি দক্ষ ও পেশাদার ড্রাইভার হয়ে যেতে পারেন না। দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের জন্য পরিমিতিবোধ  এবং ভারসাম্য বজায় রাখার সক্ষমতা জরুরি। পরিমিতিবোধ এবং ভারসাম্য বজায় রাখার সক্ষমতার অভাবেই ঘটে থাকে জগতের যাবতীয় অনাচার।  আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে মহাবিশ্বের দৃষ্টান্ত দিয়ে জীবনে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছেন। ভারসাম্য মানুষ তখনই প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যখন সে ধৈর্যশীল, যখন সে ঠান্ডা মাথায় কাজ করে এবং কথা বলে। একজন মানুষের ব্রেন সাইকেল কীভাবে কাজ করছে, সেটার ওপর নির্ভর করে তার পরিমিতি এবং ভারসাম্য বজায় রাখার সক্ষমতার ওপর। যখন মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়ে, দ্রুততার তাগিদ অনুভব করে, বিরক্তিবোধ করে, দুর্নীতির পোকা কিলবিল করে মনের ভেতর, তখন তার ব্রেন সাইকেল স্বাভাবিক থাকে না, তখন সে সহজ কাজটিও সুন্দরভাবে করতে পারে না। এ ধরনের মানুষ কখনোই কোনো কাজে দক্ষ হতে পারে না, পেশাদার হতে পারে না। বলাই বাহুল্য, আমাদের সমাজে পেশাদারিত্ব, দক্ষতা অর্জন ও চর্চার জায়গাটি খুবই সংকীর্ণ, কমবেশি সব জায়গাতেই।

অগণিত যানবাহন ও মানুষের চলাচলের মধ্যে যে কোনো ধরনের গাড়ি চালানো সহজ কাজ নয়। এ জন্য দরকার  সত্যিকারের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা, কেবল লাইসেন্সধারী হলে চলে না। কোন পরিস্থিতিতে, কোন রাস্তায়, কোন গতিতে গাড়ি চালাতে হবে- সে ব্যাপারে দক্ষ ড্রাইভার ঠিক জানেন। তিনি দুর্ঘটনা ঘটান না, তার গাড়ি জীবন হরণ করে না। আমাদের রাজপথে ড্রাইভারদের সেই সচেতনতা নেই অধিকাংশের। যারা বাস ও অন্যান্য বাহনের যাত্রী, তাদের মধ্যেও রয়েছে সেই সচেতনতার অভাব। অনেক ড্রাইভারের তো আবার ঠিকঠাক লাইসেন্সও নেই। বাসের

যাত্রীদের বেশিরভাগই ভাড়া নিয়ে তর্কে মেতে থাকেন, ড্রাইভারও সেই তর্কে জড়িয়ে পড়েন, গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে কথা বলেন। ছোট গাড়ির ড্রাইভাররাও এই কাজ করে। এদের তো মাথা গরম হয়েই থাকে। পরিমিতি বোধ কাকে বলে, তা এরা জানেই না। এ ধরনের ড্রাইভাররাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজপথে বিপর্যয় ডেকে আনে।

খুব নিবিড়ভাবে যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে দেখা যাবে সমাজে অন্য যতসব অনাচার ঘটে চলেছে, সড়ক দুর্ঘটনার বহুলতার কার্যকারণ তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সমাজে যে অস্থিরতা, পরিমিতিবোধের অভাব এবং ভারসাম্যহীনতার প্রাবল্য, রাজপথেও সেটারই বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে মন বদলাতে হবে। কথায় ও কাজে ভারসাম্য রক্ষার সামাজিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন। সমাজ ও রাজনীতিকেও  বদলাতে হবে। সীমা লঙ্ঘন করার প্রবণতা থেকে আমাদের ফিরে আসতে হবে সীমার মধ্যে।

দেশের রাজপথগুলো একেকটি মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। আইন ও নিয়মনীতি ঠিকমতো কাজ করছে না। দিনের পর দিন এটা চলতে পারে না। নিশ্চিত করতে হবে সব মানুষের নিরাপদ চলাচল। মায়ের কোল খালি হবে আর কত! আর কত রক্ত চায় যন্ত্রদানব, আর কত চায় স্বজনহারা মানুষের কান্নার লোনা জল।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads