• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

নতুন উদ্যমে উন্নয়নে গতি আসবে

  • রেজাউল করিম খোকন
  • প্রকাশিত ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশের জন্য হবে ঐতিহাসিক। কারণ এ সময়ে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এই প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে নতুন সরকার গভীর মনোযোগী হবে। তাহলে উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন নজির স্থাপন করতে সক্ষম হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হবে। নতুন কর্মসংস্থানও বাড়বে। ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ বা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার পাওয়া ১০টি বড় উন্নয়ন প্রকল্পে গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে নতুন সরকার। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের মাধ্যমে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রকল্পগুলোকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রণয়ন করা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে ঘুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, রামপাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প লক্ষ্য অনুযায়ী বাস্তবায়ন কাজ এগোয়নি।

বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নানামুখী জটিলতার কারণে অগ্রাধিকারের এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে নদীর নিচে মাটির বৈশিষ্ট্য বড় বাধা। আবার দোহাজারী ঘুনদুম রেলপথ স্থাপন দেরি হচ্ছে জমি অধিগ্রহণ না হওয়ার কারণে। পাশাপাশি জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ব্যস্ত হয়ে পড়ায়ও প্রকল্পটি কিছুটা ধীর হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্প দেরি হয়েছে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার কারণে। এ ছাড়া শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সেবা সংযোগ স্থানান্তর করার কাজও এ প্রকল্পের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশবাদীদের বাধার মুখে পড়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেও প্রকল্পগুলো কাঙ্ক্ষিত গতি পায়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আশা করা হচ্ছে এসব সমস্যার অনেকটাই কেটে যাবে। নতুন সরকার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অবশ্যই গতি আসবে।

মেগা প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়নে বড় সমস্যা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী প্রকল্প গত ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নিয়েছিল সরকার; কিন্তু সম্ভব হয়নি। মূল সেতুর কাজ করতে না পারায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এক বছর বাড়ানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির সার্বিক ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৬০ ভাগ। মূল সেতুর ভৌত অগ্রগতি ৭০ ভাগ। নদীশাসন কাজের ভৌত অগ্রগতি ৪৬ ভাগ। জাজিরা ও মাওয়া সংযোগ সড়কের ১০০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সার্ভিস এরিয়া-২-এর কাজও শতভাগ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত ১৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে মেট্রোরেল প্রকল্পটি আটটি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভায়াডাক্ট ও স্টেশন নির্মাণে নেওয়া হয়েছে সিপি-৩ ও ৪ প্যাকেজ। এ প্যাকেজের ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ শেষ হয়েছে, আর আর্থিক ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ২৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৩ দশমিক ২০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও তিনটি স্টেশন নির্মাণে নেওয়া হয়েছে সিপি-৫ ও ৬ প্যাকেজ। বর্তমানে এ অংশে স্টেশন এরিয়ার চেকবোরিং ও পরিষেবা (বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন লাইন) স্থানান্তর শেষ হয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প কাজ ২০১৬ সালের প্রথম থেকে শুরু হলেও এ পর্যন্ত মাত্র ১৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রেললাইনের মূল কাজ শুরু হয়নি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুর জেলার ৫৮২ একর জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। আর ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ ও যশোর জেলায় এক হাজার ২০৩ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই রেল চালু করতে চান প্রধানমন্ত্রী। সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন কাজ চালিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী রেলপথ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন। যদিও ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

দোহাজারী থেকে ঘুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ গত নভেম্বর পর্যন্ত ১২ শতাংশ কাজ হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে চট্টগ্রাম জেলায় সাধারণ মানুষের ৩৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। জেলা প্রশাসক এরই মধ্যে ২৭১ একর জমি অধিগ্রহণ করতে পেরেছেন। কক্সবাজার জেলায় এক হাজার তিন একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন। এর মধ্যে ৪৮৯ একর অধিগ্রহণ হয়েছে। এ ছাড়া দুই জেলায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ২০৪ একর এবং সড়ক ও জনপথ, পাউবো, কৃষি উন্নয়ন বিভাগের ২১ একর জমি অধিগ্রহণ করার কাজ শেষ হয়নি। ২০১০ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প ২০২২ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা।

ব্যয়ের হিসেবে দেশের বৃহত্তম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের পারিপার্শ্বিক অনেক কাজ হলেও মূল কাজ এখনো শুরু হয়নি। তবে প্রকল্পের মূল পর্যায়ের অর্থায়নের জন্য এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রথম ইউনিটের রি-অ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং এবং টারবাইন বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন ঢালাইয়ের প্রস্তুতিমূলক কাজ চলমান। অক্সিলিয়ারি বিল্ডিংয়ের সয়েল স্ট্যাবিলাইজেশনের কাজ শেষ হয়েছে এবং ফাউন্ডেশন ঢালাইয়ের প্রস্তুতিমূলক কাজ চলমান। এ ছাড়া ফায়ার ফাইটিং বিল্ডিংয়ের সয়েল স্ট্যাবিলাইজেশনের কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের রি-অ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের সয়েল স্ট্যাবিলাইজেশন ও কনক্রিট বিল্ডিংয়ের কাজ চলমান। এ ছাড়া টারবাইন বিল্ডিংয়ের সয়েল স্ট্যাবিলাইজেশনের কাজও চলমান।

২০১৪ সালে শুরু হওয়া মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি মাত্র ১৯ শতাংশ। প্রথম প্যাকেজে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। মাতারবাড়ী ১৩২ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণও শেষ হয়েছে। ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট থেকে চ্যানেল ড্রেজিং কাজ চলমান রয়েছে। এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্পটির বড় অংশ বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর তরল প্রাকৃতিক গ্যাসবাহী (এলএনজি) জাহাজ থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল শিগগির শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আনোয়ারা-ফৌজদারহাট এবং চট্টগ্রাম-ফেনী বাখরাবাদ গ্যাস লাইন স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।

রামপাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পটি পরিবেশবাদীদের ব্যাপক বাধার মুখে পড়লেও বাস্তবায়ন হচ্ছে। এরই মধ্যে সার্বিক প্রকল্পের ১৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মূল কাজে অগ্রগতি মাত্র ১৯ ভাগ। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক ও অফিস নির্মাণ, ড্রেজিং কার্যক্রম ও জলযান সংগ্রহ কার্যক্রম চলমান। মূল বন্দরের অবকাঠামোকে ১৯টি অঙ্গে ভাগ করে প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশন থেকে নীতিগত অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মূল অবকাঠামো নির্মাণ, নদীতীরের দায়দায়িত্ব এবং গৃহায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য আলাদা তিনটি অংশ বাস্তবায়নের জন্য চীনা কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। ভারতীয় তৃতীয় এলওসির আওতায় পায়রা বন্দর বহুমুখী টার্মিনাল স্থাপনের একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। 

সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্ভাব্যতা ২০০৯ সালে শেষ হলেও এখন পর্যন্ত অর্থায়নের জন্য সহযোগী কোনো দেশ বা সংস্থা পাওয়া যায়নি। সরকার জি টু জি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সহযোগী দেশ বা সংস্থা খুঁজছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও চীন এ বন্দর নির্মাণে অর্থায়নের আগ্রহ দেখিয়েছে।

নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘আমি সবসময়ই আশাবাদী মানুষ। স্বপ্ন দেখাতে পছন্দ করি। মানুষকে বিশ্বাসের জায়গায় নিতে ও স্বপ্ন দেখাতে হবে। স্বপ্ন দেখানোর পর সেগুলো বাস্তবায়নে আমি সবসময়ই জোর দিয়ে থাকি। আমরা এতদিন নানা অবকাঠামো, বিশেষ করে রেললাইন, বন্দর, সড়ক, সেতু কিংবা উন্নত ভবন তৈরি করেছি। এগুলোর পাশাপাশি আমরা নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে যাচ্ছি। সেটি হচ্ছে বিশ্বাস ও আস্থা। এটি শক্তিশালী অবকাঠামো। আমরা যে স্বপ্ন দেখাব, সেটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি, তা দেখাতে পারলেই মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। মানুষের মধ্যে যখন বিশ্বাস জন্ম নেবে, তখন তারা সম্পূর্ণরূপে কাজ করতে এগিয়ে আসবে।’

আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ সমৃদ্ধি ও সাফল্যের নতুন সোপানে উন্নীত হবে। মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। তবে যে কোনো মূল্যে অগ্রাধিকার পাওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে দায়িত্ব অবহেলা, দীর্ঘসূত্রতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, অসততার কোনো সুযোগ নেই।

 

লেখক : ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিকরে জা উ ল  ক রি ম  খো ক ন

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads