• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

মানুষ কি শিকারি প্রাণী

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অতি শক্তিশালী শিকারি প্রাণী হিসেবে মানুষ অতুলনীয়। মানুষের শিকারের ধরন নির্মম। আধুনিক নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ নিজেদের সর্বনিম্ন ঝুঁকিতে রেখেই বেশি বেশি শিকার সম্পন্ন করতে পারছে। মানুষের এই আধিপত্যের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অন্যান্য প্রাণী ও প্রজাতির ওপর। শিকারি হিসেবে মানুষের নিষ্ঠুরতা এবং বিভিন্ন প্রাণীর ওপর তার প্রভাব নিয়ে সারা বিশ্বের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কানাডার একদল বিজ্ঞানী সায়েন্স সাময়িকীতে এসব কথা জানিয়েছেন। চোখ বন্ধ করে ভাবলেই এ কথার প্রমাণ পাই। মানুষ কী না করে। খাবারে বিষ মেশায় মানুষ, ওষুধে ভেজাল করে মানুষ। সায়েন্স সাময়িকীতে বলা হয়েছে, সামুদ্রিক প্রাণীদের শিকার হয়ে পূর্ণবয়স্ক মাছের সংখ্যা যত কমেছে, মানুষের কারণে কমেছে তার চেয়ে ১৪ গুণ বেশি। আর স্থলে ভালুক, নেকড়ে ও সিংহের মতো বিভিন্ন শিকারি প্রাণী হত্যা করছে মানুষ। এসব প্রাণী পরস্পরকে যে হারে শিকার করে, সে তুলনায় তারা নিজেরাই মানুষের শিকার হচ্ছে নয় গুণ বেশি। গবেষণায় তারা দেখতে পান, শিকারি মানুষের আগ্রাসন জলে-স্থলে অন্যান্য প্রজাতির জন্য এতটাই বিপর্যয়কর যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব প্রাণীর ক্রমবিকাশের ধারাই বদলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মানুষ যে শিকারি প্রাণী এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ হয়তো নেই। কেননা মানবজাতি সৃষ্টির পর থেকেই বনে-জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করে। আর বনে-জঙ্গলে হিংস্র পশু ও প্রাণীদের থেকে আত্মরক্ষা করে নিজেদের আহার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকার জন্যে প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ শিকারের ক্ষেত্রে কৌশলী হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদিমকাল থেকে শিকারের প্রবণতা মানুষজাতি কি আধুনিক সভ্যতায় ভুলতে পেরেছে?  আমরা কি বুকে হাত রেখে বলতে পারব  মানুষ এখন আর শিকার করবে না? দেখুন না- বনের হরিণ, বাঘ, সাপ, পাখি সহসাই মানুষের শিকারে পরিণত হয়। হিংস্র মাংসাশী বাঘ, বিষধর সাপকে যে মানুষ শিকার করতে পারে সেই তো সবচেয়ে বড় শিকারি। দেখুন না কত নির্মম, নির্দয় আর নিষ্ঠুরভাবে মিয়ানমারের বুড্ডিস্টরা আরাকান রাজ্যে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ নিরীহ স্ব-জাতি (মানুষ)-দের হত্যা করছে। একজন ভালো থাকার জন্য অপরজনকে হত্যা বা নিধন করার এমন শিকারি প্রবণতাই প্রমাণ করে মানুষই সবচেয়ে বড় শিকারি!

অন্যান্য শিকারি প্রাণীর চেয়ে মানুষের শিকারের ধরন আলাদা। আগে মানুষ বিপজ্জনক নানা উপায়ে শিকার করত। এখন অত্যাধুনিক বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাণী হত্যা করা হচ্ছে। স্তন্যপায়ী প্রাণী হত্যায় বন্দুকের গুলি এবং মাছ শিকারে জাল ও হুক ব্যবহার করা হচ্ছে। নিজেদের নিরাপদে রেখেই শিকার করার এই সুবিধাটা অন্য কোনো শিকারি প্রাণী পায় না। আজকের এই লেখায় দেখা যাক প্রমাণ হয় কি-না। ধামরাইয়ের গভীর জঙ্গলে পলিথিনের ব্যাগে শিশুকে জীবিত উদ্ধার করেছে এলাকাবাসী। ভোররাতে পথচারীরা শিশুটির কান্না শুনে প্রথমে ভয়ে দৌড় দেয়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সবাই মিলে জঙ্গলে গিয়ে পলিথিনের ব্যাগ থেকে শিশুটি উদ্ধার করে। এটা কি মানুষের শিকারি প্রবণতার পরিণতি, নাকি ফসল- কী বলা যায়।

মানুষের শিকারি প্রবণতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে দেখুন। কবর থেকে লাশ তুলে কঙ্কাল নিয়ে বিক্রি করছে। জীবন্ত মানুষের কিডনি কেটে নিয়ে লাশ ফেলা হয় নদীতে। ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে নাটোরে তানভীর হোসেন নামে এক মাদরাসাছাত্রকে হত্যা করেছে তার তিন সহপাঠী। অপহূত ওই মাদরাসাছাত্রের লাশ সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়। বিদেশি সিরিয়াল দেখে অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে উৎসাহিত হয় বলে স্বীকার করেছে তিন হত্যাকারী। চরম নির্মমতার লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে। বংশদ্বন্দ্বে ৪ শিশুকে খুন করে মাটিচাপা দেওয়া হয়! এটা কি মানুষের শিকারি প্রবণতার প্রতিফলন নয়? সভ্যতার নামে আমরা কি আদিম নৃশংসতার যুগে চলে যাচ্ছি না।

কেন জানি মনে হচ্ছে মানুষজাতি আবারো আদিম বর্বরতার খোলস উন্মোচন করছে। একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে শত বিরোধ, প্রতিহিংসা থাকলেও মানুষে মানুষে এত খুনোখুনির বর্বরতা ত্রিশ বছর আগে ছিল না। হীন স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানুষ মানুষের জীবন নিয়ে নিত না। শিশু ও নারীর বিষয়গুলো ছিল আরো স্পর্শকাতর। আধুনিক সভ্যতায় মানুষজাতি শিখেছিল নারী ও শিশুর প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে হয়।  তাদের প্রতি বেশি মানবিক হতে শিখেছিল মানুষ। কিন্তু আজকের সভ্যতায় আমরা এসব কী দেখছি, কী জানছি। এটা কি মানুষের শিকারি পরিণাম!

ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখলাম, ভাবলাম মানুষের শিকারি প্রবণতার প্রমাণ আছে এই কথাগুলোতে। দেখুন মেলে কি-না, মুচি চায় আপনার জুতো দ্রুতই ছিঁড়ে যাক। ডাক্তার চায় আপনি ঘন ঘন অসুখে পড়ুন। পুলিশ চায় আপনি বেআইনি কাজ করুন অথবা ফাঁদে পড়ুন। উকিল চায় আপনি মামলায় জড়িয়ে যান। আপনার বাড়ির ওয়্যারিং, লাইট, ফ্যান, ফ্রিজ, টিভি নষ্ট হোক এমনটি চায় ইলেকট্রিশিয়ান। বাড়িওয়ালারা চান জীবনে যেন আপনি বাড়ির মালিক না হতে পারেন। ব্যাংকার চান আপনি টাকা লোন নিয়ে ঋণগ্রস্ত হোন। গৃহশিক্ষক চান আপনার সন্তান বইয়ের পড়া কম বুঝুক।

মানুষের এসব ফাঁদচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে মূলত মানুষই। যেমন যে ব্যক্তি কার্বাইড দিয়ে কলা পাকায়, সেই ব্যক্তি ফরমালিনযুক্ত মাছ খায়। আবার যে ব্যক্তি ফরমালিন মিশিয়ে মাছ বিক্রি করে, সেই ব্যক্তি অতিরিক্ত কীটনাশকযুক্ত ফলমূল ও সবজি খায়। ভেবে দেখলে সহজ হয়ে যায় ব্যাপারটা। কোনো ধরনের ফাঁদ পেতে অন্যকে শিকার করলেও নিজের জন্যেও অনেক ফাঁদ পাতা আছে এই মনুষ্য সমাজে। এ অবস্থা থেকে বাঁচার কি কোনো উপায় নেই? উপায় আছে অনেক, আর তা হলো- সৎ, সুন্দর জীবনযাপন করা। অতিলোভী মানসিকতা পরিহার করা। একা সব ভোগ করার প্রবণতা পরিত্যাগ করা। যে কোনো মূল্যে অর্থ কামানোর মানসিকতা পরিহার করা।

 

লেখক : বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads