• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ছয় টুকরো লাশ ও পূর্বাপর

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

খুনের ঘটনা যেন এদেশে প্রাত্যহিক। ছোট-বড় কোনো না কোনো খুন প্রতিদিনই ঘটছে কোথাও না কোথাও। তার কিছুটা আমরা জানতে পারি, অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে যায়। শুধু বড় ধরনের খুন কিছু সময়ের জন্য নাড়িয়ে দেয় জনতাকে। তারপর সেই চিরাচরিত বিচারহীনতা। অতঃপর বিস্মৃতি।

বিচিত্র ধরনের খুন হয় এদেশে। যৌতুকের জন্য, স্বামীর নির্যাতনে, পরকীয়ার কারণে, জমিজমা, টাকা-পয়সা ইত্যাকার স্বার্থে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে। এমন অসংখ্য কারণে খুনের ঘটনা বাড়তেই থাকে। নতুন খুন যেমন পুরনো খুনকে ঢেকে দেয়, অনেক সময় মনে করিয়েও দেয়।

সম্প্রতি একটি খুনের ঘটনা আলোচনায় এসেছে। গাজীপুরের শ্রীপুরে জেবুন্নাহার নামের এক মহিলা তার স্বামীকে খুন করেন। জানা যায়, স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে খুন করেছেন তিনি। আর এই অত্যাচারের কারণ অর্থ। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, স্বামীর চেয়ে স্ত্রী বেশি বেতন পেতেন। স্ত্রীর বেতনের টাকা স্বামী চাইতেন। স্ত্রী তাকে টাকা দিতেন না। টাকা রাখতেন মায়ের কাছে। এ নিয়ে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হতো। ঘটনার দিনও টাকা নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়ার একপর্যায়ে স্বামী স্ত্রীকে থাপ্পড় দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। আর স্ত্রী স্বামী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইটের টুকরো দিয়ে তার মাথায় আঘাত করলে তিনি খাট থেকে নিচে পড়ে যান। এরপর উপর্যুপরি আঘাত করলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। তখন স্ত্রী জেবুন্নাহার তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। তারপর স্বামীর লাশ ওয়ার্ডরোবে লুকিয়ে রেখে তার কর্মস্থল মেঘনা নিট কম্পোজিট কারখানায় চলে যান। কাজ শেষে ফিরে পাশে বোনের বাসায় রাতের খাবার খান। খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ১১টার দিকে ঘরে ফিরে ওয়ার্ডরোব থেকে স্বামীর বডি বের করেন। তারপর যে নৃশংসভাবে স্বামীর দেহকে টুকরা টুকরা করেন তা খবরের কাগজের মাধ্যমে পাঠক অবগত আছেন। কী নৃশংস হত্যাকাণ্ড সামান্য টাকার জন্য! এই দম্পতির পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়। মারিয়া নামে তাদের চার বছরের একটি মেয়ে আছে। এই বস্তাবন্দি দেহ মনে করিয়ে দেয় ট্রাঙ্কবন্দি নীহার বানুর কথা। মনে করিয়ে দেয় সালেহা, শারমিন রীমা, সাগর-রুনি, তনু, রিশাসহ আরো অনেক অনেক হত্যাকাণ্ডকে ।

২৭ জানুয়ারি ১৯৭৬। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চেপে ক্লাস করতে ক্যাম্পাসে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নীহার বানু। সন্ধ্যা নামার পরও মেয়ে বাসায় ফেরে না। বিধবা মা দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। কোথাও সন্ধান পাওয়া যায় না। শঙ্কা, উৎকণ্ঠায় রাত পার করে পরদিন পরিবারের সদস্যরা গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, খোঁজ করা হলো ক্লাসে, মেয়েদের হলে; কথা বললেন বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষকদের সঙ্গে। জানা গেল আগের দিন সকালে নীহার বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকই গিয়েছিলেন। সহপাঠীরা বললেন, নীহার ক্লাসে ছিলেন, হাজিরা খাতা দেখে শিক্ষকরা তার ক্লাসে উপস্থিত নিশ্চিত করলেন। কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। এরপর আর নীহারের খবর পাওয়া যায়নি অনেকদিন।

নীহার বানু নিখোঁজের পর তার সহপাঠী বাবুকেও দেখা যাচ্ছিল না ক্যাম্পাসে। বাবু তাকে একতরফা ভালোবাসত। অনেকে ধারণা করেছিল হয়তো তারা একসঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু নিখোঁজের তিন দিন পর বাবুকে ক্যাম্পাসে দেখা যায়। দেখা যায় বাবুর বন্ধু মিন্টুকে। মিন্টুর সঙ্গে নীহার বানুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হলে মিন্টু মাটির দিকে চোখ রেখে কথা বলতেন। তার এ পরিবর্তনে সন্দেহ জাগে পরিবারের সদস্যদের মনে। তারা পুলিশকে জানান। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। অন্যদিকে সেতু নামের এক যুবক হাতের কনুইয়ে ক্ষত নিয়ে আসে এক চিকিৎসকের কাছে। জানায় কুকুর কামড়েছে তাকে। ক্ষত দেখে চিকিৎসক বুঝেছিলেন ক্ষতটি কুকুরের কামড়ের নয়, মানুষের। তিনি পুলিশকে জানালেন। সেতুকে গ্রেফতার করা হলো। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর স্বীকারোক্তি দেয় সে। সেতু পুলিশকে নিয়ে যায় একটি বাড়িতে। বাড়ির উঠোনের এক কোণে সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা একটি জায়গা। জায়গাটা খুঁড়ে পুলিশ বের করে একটি ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্ক খুলতেই সবাই স্তম্ভিত বিস্ময়ে দেখে ট্রাঙ্কের ভেতরে শুয়ে নীহার বানু! নিখোঁজের সাড়ে পাঁচ মাস পর এভাবেই উদ্ধার করা হয় তার লাশ, মানে কঙ্কাল।

নীহার বানু হত্যাকাণ্ড আলোড়ন তুলেছিল সারা দেশে। সুন্দরী নীহার বানুকে বিয়ে করতে চেয়েছিল তার সহপাঠী আহমেদ হোসেন বাবু । নীহার রাজি হননি। বাবু তা মেনে নিতে পারেনি। একদিন বাবু ও বাবুর বন্ধু সেতু, মিন্টু ও আরো কয়েকজন মিলে ক্লাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে শহরের ‘মীনা মঞ্জিল’ নামের একটি বাড়িতে নিয়ে যান নীহারকে। সেখানে তারই শাড়ি দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করেন।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশিত হলে প্রতিবাদে মুখর হন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তারা হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে মিছিল-মিটিং করেন। বিচারে ফাঁসি হয় বাবুর। কিন্তু বাবুসহ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুজন আজো পলাতক।

এদেশের ইতিহাসে আরেকটি আলোচিত ঘটনা সালেহা হত্যা। যৌতুকলোভী ডা. ইকবাল তার বাড়ির গৃহপরিচারিকার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়লে সংসারে নেমে আসে অশান্তি। স্ত্রী এসবের প্রতিবাদ করলে ফুঁসে ওঠেন ডা. ইকবাল। শুরু হয় স্ত্রীর ওপর নির্যাতন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের ১৮ এপ্রিল স্বামীর হাতে খুন হন সালেহা।

১৯৮৯ সালের ৯ এপ্রিল স্ত্রী শারমিন রীমাকে হত্যা করেন মনির হোসেন। নিহত রীমা ছিলেন শহীদ সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদের মেয়ে। অন্যদিকে খ্যাতনামা ডাক্তার বাবা-মায়ের ব্যবসায়ী ছেলে মনির হোসেন। বিয়ের তিন মাস পর স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়ে খুন হন শারমিন রীমা। মনির ছিলেন চারিত্রিকভাবে অত্যন্ত বাজে। মনিরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের হোসনে আরা খুকুর। বিয়ের পর মনির রীমাকে কোনোদিনই মন থেকে মেনে নেননি। তিনি সম্পর্ক রেখেছেন খুকুর সঙ্গে। খুকু-মনিরের এ অবাধ সম্পর্কের মধ্যে রীমাকে উটকো ঝামেলা হিসেবে বিবেচনা করে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড মাঝে মাঝে সমাজকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তোলে। মানুষ অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তোলে। কিন্তু তারপরও অপরাধপ্রবণতা কমছে না। নীহার বানু, সালেহা এবং রীমা হত্যার ঘটনায় সমাজে একটি প্রতিবাদী তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল। আর এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না- এমন আশাবাদ জেগেছিল মনে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং বলা চলে বর্তমানে তা বহুলাংশে বেড়েছে। অপরাধীর শাস্তি না হওয়াই অপরাধপ্রবণতা প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজ বাসায় রহস্যজনকভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার এবং মেহেরুন রুনি। আজো সাগর-রুনির হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় খুন হয় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু। হত্যাকাণ্ডের হোতাদের গ্রেফতার তো দূরের কথা, তদন্তই ঘুরপাক খাচ্ছে দিনের পর দিন নানান অজুহাতে। চট্টগ্রামের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা মামলাটিও শেষ পর্যন্ত সাগর-রুনি এবং তনু হত্যা মামলার পরিণতি বরণ করবে হয়তো। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, নীতি বা মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণেই আমাদের সমাজে নানা ধরনের অপরাধকর্ম একের পর এক সংঘটিত হচ্ছে। আর এসব অপরাধপ্রবণতার ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতির অন্যতম কারণ বিচার এবং সাজা না হওয়া, এটাও অনস্বীকার্য।

জেবুন্নাহার তার স্বামী রফিকুল ইসলামকে যেভাবে খুন করে ঠান্ডা মাথায় ওয়ার্ডরোবে লাশ লুকিয়ে রাখে, অফিসে যায়, ফিরে এসে বোনের বাড়িতে খেয়ে নিজ হাতে বঁটি দিয়ে স্বামীকে ছয় টুকরো করে, তা যে কোনো হরর ছবিকে হার মানায়। মনে হয় বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভব হয়েছে। মানুষের নৈতিক অবক্ষয় এতটাই ঘটেছে যে, এমন ভয়াবহ খুন এবং খুনের পরবর্তী নৃশংসতম কাজ করছে চরম নির্লিপ্ততা নিয়ে ঠান্ডা মাথায়। একগুলিতে বা এক কোপে খুন আর এ-জাতীয় খুনের মধ্যে তফাত আছে। চরম উত্তেজনায় মানুষ গুলি করে বা কুপিয়ে হত্যা করতে পারে; কিন্তু মৃত মানুষকে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে লুকিয়ে রাখা বা ফেলে দেওয়া শুধু ঠান্ডা মাথার প্রফেশনাল খুনির পক্ষেই সম্ভব। যদিও সব খুনই জঘন্যতম অপরাধ।

রফিকুল ইসলামের যেমন উচিত হয়নি দিনের পর দিন বেতনের টাকার জন্য স্ত্রীকে চাপ দিয়ে নির্যাতন করা, তেমনি জেবুন্নাহারেরও ভাবা উচিত ছিল সংসারটা দুজনের। স্বামীর মাত্র ৭ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলা সম্ভব নয়। নিজে থেকেই তার সংসারে কিছু টাকা দেওয়া উচিত ছিল। সে পুরো টাকা মায়ের কাছে রেখে স্বামী বা সংসারের প্রতি সুবিচার করেনি। এক ছাদের নিচে এতগুলো বছর কাটানোর পরও স্বামী বা সংসারের প্রতি তার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা জন্মায়নি। ভালোবাসা ছিল টাকার প্রতি। তাই পেরেছে নিজ হাতে স্বামীকে খুন করে অফিসে যেতে, ভাত খেতে, লাশ টুকরো করতে। সন্তানকে পিতৃহারা করতে তার এতটুকুও বাধেনি।

কারণ যদি খুব জোরালোও হয়, তবু কোনো খুনই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা চাই নিরাপদ বলয়ে শান্তিতে বাঁচতে। চাই আমাদের সন্তানরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে চলাফেরা করবে। চাই নির্ভার নিশ্চিন্ত জীবন। আমরা সেই পরিবেশ চাই। আর সে জন্য যত কঠোর হতে হয় সরকারকে, তা-ই হতে হবে। আর স্কুল থেকে শুরু করতে হবে নৈতিক শিক্ষার চর্চা, বের করতে হবে অপরাধপ্রবণতা হ্রাসের পথ। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন ভালোবাসাময় একটা সুস্থ জীবন আমরা পাব।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads