• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

পুলিশের প্রতি জনগণের অনাস্থা

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ০২ মার্চ ২০১৯

১৯৮৪ সালের ঘটনা। দেশে স্বৈরশাসক এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। পুলিশকে নিয়ে একটি কঠিন মন্তব্য করে একবার বেশ বিপাকে পড়েছিলেন সাপ্তাহিক রোববারের এক তরুণ সাংবাদিক। আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশকে নিয়ে লেখা এক বিশেষ প্রতিবেদনে তিনি একটি বাক্য প্রয়োগ করেছিলেন, যা পুলিশ কর্তৃপক্ষ হজম করতে পারেনি। তারা ওই মন্তব্যের কারণ অনুসন্ধান না করে উল্টো ওই সাংবাদিকের ওপরই খড়গহস্ত হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য ভাগ্য ভালোই ছিল তার। সে সময়ের সবচেয়ে বড় মিডিয়া হাউজের সংবাদকর্মী হওয়ায় হেনস্তা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। পরে তাকে পাড়ি জমাতে হয়েছিল সুদূর জার্মানিতে। তাতে অবশ্য আমাদের সাহিত্যজগতের লাভই হয়েছিল। প্রায় অর্ধদশকের প্রবাসজীবন কাটিয়ে তিনি দেশে ফিরেছিলেন বেশ কয়েকটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে, যেগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক সমাদৃত হয়েছে। সেদিনের সেই তরুণ সাংবাদিক বর্তমানে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। একাধারে তিনি একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকও। না, সেই সাংবাদিক-সাহিত্যিকের মন্তব্য ও ভোগান্তির কাহিনির বর্ণনা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে ঘটনাটি এখনো প্রাসঙ্গিক। যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তিনি সেদিন পুলিশ সম্পর্কে তীব্র মন্তব্যটি করেছিলেন, তা যে আজো বদলায়নি তা বলাই বাহুল্য। অনেকের কৌতূহল হতে পারে কী লেখা হয়েছিল সে রিপোর্টে? না, তার পুনরুল্লেখ সঙ্গত কারণেই করব না। কারণ, স্বপ্রণোদিত হয়ে বিপদ ডেকে আনা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

আমাদের পুলিশ সম্পর্কে অভিযোগের অন্ত নেই। প্রতিনিয়ত অভিযোগ পাওয়া যায় জনসাধারণের একেবারে কাছাকাছি থাকা রাষ্ট্রীয় এ বাহিনীটির ‘কতিপয়’ সদস্যের বিরুদ্ধে। নৈতিক অবক্ষয় তাদের এতটাই গ্রাস করেছে যে, কোনো কোনো ঘটনায় পুলিশ আর পেশাদার অপরাধীর মধ্যে পার্থক্য করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে এ বাহিনীটির একটি অংশ গোটা বাহিনীটিকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে প্রশ্নের মুখোমুখি।

‘পুলিশ ঘুষ খায়’ কথাটি এখন যেন প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। তা ঘুষের ব্যাপারটি না হয় গা সওয়া হয়ে গেছে। কারণ শুধু পুলিশ নয়, সরকারের প্রায় সব দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি বড় অংশই এখন এ কর্ম সাধনে লিপ্ত। ফলে ঘুষ লেনদেনকে এখন সবাই অলিখিত প্রথা বলেই ধরে নিয়েছেন। ইদানীং আবার ঘুষকে ‘স্পিড মানি’ হিসেবে অভিহিত করে এর বৈধতা দেওয়ারও চেষ্টা করতে দেখা যায়। ঘুষ ছাড়াও আজকাল পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ মাঝে-মধ্যেই পাওয়া যায়, সেগুলো মেনে নিতে অনেকেরই কষ্ট হয়। ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, খুন-গুমসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে পুলিশের নাম জড়ায়নি। ফলে যে পুলিশকে মানুষ একসময় বন্ধু ভাবত, এখন ভাবছে ভিন্নটা। অতিসম্প্রতি পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, তার একটি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার; অপরটি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর ও টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার পুলিশের দ্বারা সংঘটিত। ঘটনা দুটি এখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। খবরে বলা হয়েছে, পাওনা টাকা না দিয়ে এক তরুণীকে তার ভাগ্নিসহ স্থানীয় ডাকবাংলোতে দুদিন  আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে সাটুরিয়া থানার এসআই সেকান্দর হোসেন ও এএসআই মাজহারুল ইসলাম। নির্যাতিত ওই তরুণী গত ১০ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করলে তিনি তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে ওই তরুণীকে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেওয়া হয়। তরুণী গত ১২ ফেব্রুয়ারি মামলা দায়ের করলে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। এদিকে গ্রেফতারকৃত পুলিশ কর্মকর্তা দুজনকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির করা হলে মানিকগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

অপর ঘটনাটি গত ৬ ফেব্রুয়ারির। ঘটনাস্থল গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার একটি গ্যাস পাম্প। শিলাবৃষ্টি নামের ওই পাম্প থেকে গাড়িতে গ্যাস নিচ্ছিল পাঁচ যুবককে বহনকারী একটি গাড়ি। এ সময় টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার এএসআই মো. মুশফিকুর রহমান ও গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুনসহ তাদের ছয়-সাতজন সোর্স গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে গাড়িতে বসা রায়হান, লাবিব সরকার ও মাফিন নামের তিনজনকে আটক করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের রেলওয়ে ওভার পাসের নিচে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের কাছে ইয়াবা ও ফেনসিডিল রয়েছে- এ অভিযোগ এনে ৩০ লাখ টাকা দাবি করে। এমনকি তিন যুবককে ক্রসফায়ারে দেওয়ারও হুমকি দেয় পুলিশের এএসআই দুজন। বন্ধুদের আটকের খবর পেয়ে অপর দুই যুবক তরিকুল্লাহ ও রিমন বিষয়টি কালিয়াকৈর থানার ওসিকে অবহিত করেন। ওসি ঘটনা জানান মির্জাপুর থানার ওসিকে। তিনি আটক যুবকদের মির্জাপুর থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এএসআই মুশফিকুর রহমানকে নির্দেশ দেন। রাত দেড়টার দিকে তাদের থানায় নেওয়া হয়। ওসি জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পান। আটক তিন যুবককে রাতেই প্রাইভেট কারসহ ছেড়ে দেওয়া হয়। সর্বশেষ খবর হলো, ভুক্তভোগী যুবক রায়হানের করা মামলায় উল্লিখিত পুলিশ কর্মকর্তাদ্বয়কে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের অন্ত নেই। যে পুলিশ বাহিনী জনগণের জানমালের সুরক্ষা দেওয়ার মতো গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত, সে বাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ যেন রক্ষকের ভক্ষক হয়ে ওঠা। বিপদে-আপদে যাদের কাছে মানুষের ছুটে যাওয়ার কথা, তারাই যদি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কোথায় যাবে সাধারণ মানুষ? একটি সময় ছিল যখন মানুষ পুলিশের ওপর ভরসা করত। কিন্তু এখন সে ভরসা আর কেউ করতে চায় না। এমনকি চুরি-ডাকাতির মামলাও থানায় রেকর্ড করাতে আগ্রহ দেখায় না বেশিরভাগ মানুষ। কারণ এ বিষয়ে তাদের রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। পুলিশের অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশ করেছে ‘কতিপয় পুলিশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন। তাতে কালিয়াকৈরের ঘটনার সঙ্গে আরো কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি হলো চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার একটি পেট্রোল পাম্পের সামনে ফার্নিচার বোঝাই ট্রাক থেকে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র্যাব। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের এসআই বদরুদ্দোজা মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। সে স্বীকার করেছে দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে তার জড়িত থাকার কথা। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনার আগে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার এএসআই সোহরাওয়ার্দী রুবেলের কাছ থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে আরো তিন পুলিশ সদস্যের নাম বেরিয়ে পড়ে ইয়াবা কারবারি হিসেবে। পুলিশের কতিপয় সদস্যের এই যে অপকর্ম, তা যে কারো জন্যই সুখকর নয়। এদের কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সরকারকেও হতে হচ্ছে প্রশ্নের মুখোমুখি।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন এবং তা রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে থাকে। প্রতি বছর সারা দেশে বহুসংখ্যক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠছে। অনৈতিক কাজে বা অপরাধকর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার অভিযোগে প্রতি বছরই অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারপরও পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমছে না। এর কারণ অনুসন্ধানের তাগিদ অনুভব করছেন দেশের সচেতন মহল।

কারো কারো কাছে পুলিশ এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। ভুক্তভোগীরা জানেন পুলিশের কোপানলে পড়লে অবস্থা কী দাঁড়ায়। ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’ প্রবাদটির প্রচলন তো আর এমনি এমনি হয়নি। পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়ে কত মানুষের জীবনে দুর্ভোগের অমানিশা নেমে এসেছে তার হিসাব নেই। আজকাল অভিযোগ পাওয়া যায়, একজনকে টার্গেট করে ধরে এনে পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। মামলা, জেল এমনকি ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়েও আদায় করা হয় অর্থ। এসব হরহামেশাই ঘটছে। প্রতিকার চাচ্ছে মানুষ। কিন্তু অবস্থার উন্নতি নেই; বরং দিন দিন পরিস্থিতির অবনতিই ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ করে বলেছেন, কেউ যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়ে বলেছিলেন, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ যেসব সুবিধা প্রয়োজন তা সরকার  মেটাচ্ছে। তাহলে কেন দুর্নীতি হবে? তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানসিকতার পরিবর্তন এবং মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার ওপরও গুরুত্বারোপের কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্য একটি জনবান্ধব ও দেশবাসীর স্বার্থরক্ষার প্রশাসন গড়ে তুলতে তার আন্তরিকতারই বহিঃপ্রকাশ। পুলিশও রয়েছে এর মধ্যে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবাণীর অব্যবহিত পরেই সাটুরিয়ার তরুণী ও কালিয়াকৈরের তিন যুবককে পুলিশেরই কয়েকজন সদস্যের দ্বারা নিগৃহীত হতে হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান বা সতর্কবাণী ওইসব পুলিশ সদস্য কানে তোলেনি। বলা বাহুল্য, এদের নৈতিকতার অবক্ষয় এতটাই হয়েছে যে, কোনো নীতিকথাই এদেরে দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখতে পারছে না।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যে প্রেক্ষাপটে পুলিশ সম্পর্কে ওই সাংবাদিক কঠিন মন্তব্যটি করেছিলেন, সে প্রেক্ষাপট কি বদলেছে নাকি পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে? সে সময়ের আরেকটি ঘটনা বলে আজকের লেখার ইতি টানব। এক রিকশাযাত্রী ভুলে তার মানিব্যাগ সিটের ওপর রেখে নেমে চলে গেছেন। রিকশাওয়ালা তা খুলে দেখে ভেতরে বেশকিছু টাকা। কী করা যায় ভাবছে সে। অনেক চিন্তাভাবনা করে সে মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেল দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে। গিয়ে ঘটনা সাংবাদিকদের বলল এবং মানিব্যাগটি দিয়ে অনুরোধ করল যাতে একটি খবর তারা ছাপিয়ে দেন। তাহলে মানিব্যাগের মালিক ওটা পেয়ে যাবেন। কিন্তু থানায় না গিয়ে সে পত্রিকা অফিসে কেন গেল- প্রশ্ন করা হলে সে বলেছিল, থানায় গেলে এ টাকা মালিক পেত কি-না তা নিয়ে তার সন্দেহ রয়েছে। খবরটি ইত্তেফাকে ছাপা হওয়ার পর আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ওই ঘটনায়।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads