• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ভোটাধিকার এবং কিছু ভাবনা

  • মোমিন মেহেদী
  • প্রকাশিত ০৮ মার্চ ২০১৯

১ মার্চকে ভোটার দিবস ঘোষণা করায় সাধারণ ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা তৈরি হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত কমিশনার, সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কিন্তু বাস্তবতা যে ভিন্ন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে : জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ঢাকা উত্তরের উপনির্বাচন। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুই সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক। সব কেন্দ্রে নির্বাচনের পরিবেশ সুন্দর ও সুষ্ঠু ছিল। ভোট দিতে ভোটাররা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন এটা ঠিক নয়। সুন্দরভাবে ভোট হয়েছে।’

অন্যদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ভোটের পরিবেশ তৈরি করে। তারা ভোটার আনে না। তাই দুই সিটির নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি যে কম, এর দায় ইসির নয়। দায় প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সিইসি যা বলেছেন তা যথার্থই। ভোট দেওয়ার মালিক হলেন ভোটাররা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল উদ্বুদ্ধ করে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। এটাই স্বাভাবিক। এখন কে এলো, আর কে এলো না, সেটা তো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়।

গরুমার্কা ঢেউটিনের বিজ্ঞাপনের মতো করে সিইসি নিজের বিজ্ঞাপন দেওয়ার পাশাপাশি সর্বনাশ করছেন সরকারের। সরকারের নেতিবাচক সমালোচনা থেকে পিছিয়ে নেই জাসদ-বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টিসহ তথাকথিত বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ধারক-বাহকরাও। আর এই সুযোগে গড়ে তোলা হচ্ছে ভোটারহীন নির্বাচনের মাঠ। যে মাঠে নেমে হতাশার সঙ্গে পথ চলছে স্বয়ং সংশ্লিষ্টরাও। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে কম হওয়ার কারণে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রিজাইডিং অফিসাররা। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র এলাকায় মোট ভোটারের হিসাবে গড়ে ১০ শতাংশ হারে ভোট পড়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সদ্য যোগ হওয়া ১৮টি করে ওয়ার্ডে ভোটগ্রহণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারদের নেতৃত্বে একদল কর্মকর্তাকে হাজির হতে হয়েছে বুধবার রাত ৯টার মধ্যে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন অভিজাত এলাকা গুলশান-২ এর মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভোটগ্রহণ করা হয় চারটি কেন্দ্রের। সেখানে দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসার প্রমোদ কুমার নাথ সাহা গণমাধ্যমকে বলেছেন, দুটি নারী কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ৮৬ এবং ২ হাজার ১০৮ জন। বিকাল ৩টা পর্যন্ত কেন্দ্র দুটিতে ভোট পড়েছে যথাক্রমে ৪৫০ ও ৯৩০টি। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বসে থাকতে দেখা গেছে। একই অবস্থা মানারাত স্কুলের পুরুষ কেন্দ্র দুটিরও। সেখানে দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসার বিধুভূষণ রায় বলেন, পুরুষদের একটি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৬৬০টি। সেখানে মোট ভোটার ২ হাজার ৫৯৮ জন। আরেকটি কেন্দ্রে ২ হাজার ৪৮৬ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৭৬০ জন।

এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কেন? উত্তরটা আমিই নই শুধু, প্রায় সবাই-ই জানেন। বিগত সময়ের কয়েকটি নির্বাচনে এত অনিয়ম হয়েছে যে, ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এখন আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতায় অগ্রসর রাজনীতিকদের পাশাপাশি সিইসিও অন্ধের মতো আবোল-তাবোল বকা শুরু করেছেন। যে কারণে নির্বাচন নির্বাচন খেলাকেও তিনি হালাল করতে গিয়ে বলেছেন, ভোটকেন্দ্রে ভোটার না আসার দায় নির্বাচন কমিশনের নয়। এ দায় রাজনৈতিক দলগুলোর এবং প্রার্থীদের। অপরদিকে এ নির্বাচনকে অপূর্ণাঙ্গ আখ্যায়িত করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ না নেওয়ায় এটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নয়। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে তাতে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহ দেখা যায় না। ভোটের রাজনীতি এতটাই নিচে নেমে এসেছে যে, জঘন্যতর খেলায় মেতে উঠেছে ছাত্ররাজনীতিও।

স্বাধীনতার পর থেকে কোনো না কোনোভাবে ভোট প্রদানে নির্মিত হয়েছে চরম বাধা-প্রতিবন্ধকতা। তবু বাংলাদেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। ভোট দেবে তারা ২০১৯ সালের নির্বাচনে। সেই আশার গুড়ে যখন বালি পড়েছে, তখন ভোটবিমুখতা নিয়ে সরগরম রাজনীতি। ভোটার উপস্থিতির এ হতাশাজনক চিত্রে খোদ ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরাও ভীষণভাবে ধাক্কা খেয়েছেন। মুখে স্বীকার না করলেও তাদের আচার-আচরণে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন উপনির্বাচনে কোন দলের মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হবেন, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কত ভোট পাবেন— ভোটের দিনের চিরাচরিত এসব বিষয় নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন না থাকলেও ভোটকেন্দ্রে ভোটারের হতাশাজনক উপস্থিতির বিষয় নিয়ে সরগরম ছিল গোটা দেশের রাজনীতি। এমনকি খেটে-খাওয়া অতি সাধারণ মানুষও এ নিয়ে দিনভর নানা সমালোচনায় মেতেছে। এ ধরনের একতরফা নির্বাচনেও ভোটবিমুখতা কেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

তবে একথা সত্য যে, এই নির্বাচনে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই অংশ নেয়নি। বিশেষ করে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ভোট ঘিরে শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ায় নিরুত্তাপ নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের ভোটাররাও ছিল অনেকটাই নিস্পৃহ। তবে শুরু থেকেই আওয়ামী দলীয় মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম যেভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতে ভোটারের উপস্থিতি এতটা হতাশাজনক হবে তা কেউই ভাবতেও পারেননি। তবে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও এবারের নির্বাচন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল ও সুষ্ঠু হয়েছে— এমন দাবি তুলে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা ভোটের মাঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতারা ভোটবিমুখতার কারণ হিসেবে ক্ষমতাসীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থাহীনতার বিষয়টি নানাভাবে তুলে ধরেছেন।

ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ তৎপরতার পরও ভোটকেন্দ্রে ভোটারের হতাশাজনক উপস্থিতির চিত্র সাধারণ মানুষকেও ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। এতটাই নিচে নেমেছে ভোটের প্রতি ভালোবাসা বা দায়িত্ববোধ যে, মহাখালী বাস টার্মিনাল সংলগ্ন একটি টি-স্টলে একজন পরিবহন শ্রমিক এ নিরুত্তাপ ভোটের জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দায়ী করে জানান, তিনি মহাখালী ওয়্যারলেস এলাকার ভোটার হলেও এবার ভোট দিতে যাননি। এমনকি তার পরিবারের কাউকেও ভোট দিতে পাঠাননি। কেননা গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তারা নির্ধারিত সময়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়েও ভোট দিতে পারেননি। তাদের ভোট আগেই কে বা কারা দিয়ে গেছে। এ কারণে এ ভোটে তারা আগ্রহ দেখাননি।

উত্তরণ প্রয়োজন সকল স্তরে। তা না হলে ঝরে পড়তে পারে অনেক স্বপ্ন কুঁড়িতেই। যা আমাদের কারোরই প্রত্যাশা নয় বিধায়ই তুলে ধরছি সমাধানের কিছু কথা— গড়ে তুলতে হবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও মেধাবী-দক্ষ নেতৃত্ব; ছাত্র ও যুব সংগঠনের রশি টেনে ধরতে হবে; চাঁদাবাজিসহ সব অন্যায়ের রাস্তা বন্ধ করে নেতাকর্মীদের নৈতিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে; এবং সব পর্যায়ে রাজনীতিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। তবেই বাংলাদেশ একটি আদর্শভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি

সড়সরহসধযধফর—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads