• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

জলবায়ু পরিবর্তন

দুর্যোগ হ্রাসে চাই প্রকৃতিবান্ধব পদক্ষেপ

  • সাহাদাৎ রানা
  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০১৯

এখন ঝড়ের মৌসুম। মাঝে মাঝে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ আঘাত হানছে ঘূর্ণিঝড়। এসব ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ যে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর থেকে পুরোপুরি রক্ষার উপায় না থাকলেও প্রতিরোধ করে ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমিকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এজন্য এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় নীতিনির্ধারকদের টেকসই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি সবার সমিম্মিল আন্তরিক প্রয়াস বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ রাখতে পারে।

গত প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের মানুষ একটি বিষয়ের সঙ্গে নতুন করে খুব বেশি পরিচিত হচ্ছে। পরিচিত হওয়ার যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান। কেননা এর ব্যাপক প্রভাব প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনব্যবস্থায় পড়ছে। বিষয়টি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। শুধু বাংলাদেশ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। লক্ষ করা যাচ্ছে উষ্ণতা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরুদেশের বরফ গলে যাওয়ায় বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা। অপরদিকে প্রতি বছর অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রার আকস্মিক এবং ব্যাপক ওঠানামার অনুঘটক হচ্ছে আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রকৃতির এই খেয়ালিপনায় বিশ্বজুড়েই জনজীবন নানাভাবে প্রভাবিত ও বিঘ্নিত হচ্ছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির বাইরে নয় বাংলাদেশও।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের আলোচনায় আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে সম্যক অবগতি প্রয়োজন। ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের চারপাশের সিংহভাগ অংশ অর্থাৎ পশ্চিম, উত্তর আর পূর্ব সীমান্তজুড়ে রয়েছে ভারত। ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশের সঙ্গে আসাম ও মেঘালয়। পূর্বে ভারত ছাড়াও আছে মিয়ানমারের সীমান্ত। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এছাড়া উত্তর দিকে রয়েছে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালার একাংশ। যেখান থেকে বরফগলা পানির প্রবাহে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় নদী। বর্ষার সময়ে নদীবাহিত পানির প্রবাহ বেড়ে গেলে নদী উপচে পানি লোকালয়ে পৌঁছে সৃষ্টি হয় বন্যার। এজন্য নিয়মিতই নানা মাপের বন্যা হয়ে থাকে। আর এটা বলা যেতে পারে প্রতি বছরেরই চিত্র। তবে কোনো কোনো বছর সেই উপচেপড়া পানির পরিমাণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ বন্যার। ঠিক এর আগে বা পরে মড়ার উপর খাঁড়ায় ঘা হয় অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যেমন ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, নিম্নচাপ ও জলোচ্ছ্বাস জনজীবনকে ছন্নছাড়া করে দেয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের এই স্বাভাবিক চিত্রটি এখন অনেকখানি বদলে গেছে। অত্যধিক তাপমাত্রা, অতি বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি ইত্যাদি বহুমুখী পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। উপরন্তু বাংলাদেশের ইদানীংকালের জলবায়ুতে পরিবর্তন দৃশ্যমান।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত নানা লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এসব অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। সাধারণত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় বেশি হয়। এতে সমুদ্রের পানির আবাদি জমিতে প্লাবিত হয়ে চাষের জমিকে অযোগ্য করে তোলে। সৃষ্টি হয় সুপেয় পানির অভাব। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অতীব প্রয়োজন। এ অবস্থায় যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের দিকে এবার দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অন্তত ৪ কোটি মানুষের বসবাস। সাম্প্রতিক সময়ের দুটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। প্রায় এক যুগ আগে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার আঘাতের ভয়াবহ স্মৃতি বাংলাদেশের মানুষের কাছে এখনো আতঙ্কের বিষয়। জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি সে সময় অন্যান্য ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এদেশের জনগণ। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত মানুষের হয়েছে করুণ দশা। তাই শুধু সিডর বা আইলার সময় নয়, ছোট বড় ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসেও এরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপদ্রুত এলাকার মানুষ পুষ্টিহীনতায়ও বেশি ভোগে।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশাল অংশ কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। আর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ কারণে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য বিশেষত ধানের উৎপাদন কম হলে প্রায়ই চালের দাম বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে সারা দেশে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বেশিরভাগই দরিদ্র। আর এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে জার্মানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জার্মানি ওয়াচের ‘ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০১৮’র প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়, গত দুই দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের মোট জিডিপিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ২০০৭ সালে সিডরের আঘাতে বাংলাদেশের কয়েক লাখ মানুষের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উপকূল অঞ্চলে আঘাত হানার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। এতে প্রায় ১ কোটি মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব পরিসংখ্যানের বাস্তবতাকে আমলে রেখেই স্বীকার করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে এটাও সত্য যে, আগের তুলনায় দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এরই মধ্যে যথেষ্ট এগিয়েছে। বিশেষত নীতি প্রণয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেওয়া হয়েছে দৃশ্যমান পদক্ষেপ। তবে এক্ষেত্রে আমাদের সামগ্রিক সাফল্য যেমন আছে তেমনি আছে চ্যালেঞ্জও। এর মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা বৃদ্ধি আর অর্থায়ন।

বিশ্বব্যাপী শিল্পায়নের জন্য কার্বন নিঃসরণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এজন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ হচ্ছে সবুজের বৃদ্ধি। অর্থাৎ ব্যাপক বনায়ন। কেবল কার্বন নিঃসরণ হ্রাসই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায়ও এই বনায়নের কার্যকর ভূমিকা অপরিসীম। এক্ষেত্রে কেবল সরকার নয়, এগিয়ে আসতে হবে শিল্পপতিদেরও। প্রতিটি শিল্পকারখানায় কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ হ্রাসের পাশাপাশি কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। এক্ষেত্রে শিল্পকারখানার মালিকদের এসব বন্ধ করার জন্য বাধ্য করতে হবে। সবুজ ও পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরি, ডেলাইট সেভিং, উপকরণের পুনর্ব্যবহার এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি সবুজের বিকল্প নেই। কেননা ব্যাপক বনায়ন পারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে আমাদের অনেকটা রক্ষা করতে। তাই ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত মোকাবেলায় উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনায়ন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সমুদ্রের লবণাক্ত পানি যাতে কূল ছাপিয়ে মিঠা পানিতে মিশতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ, পানি দূষণ যাতে প্রতিরোধ করার পাশাপাশি এর নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রয়োজন। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষিজীবীরা কীভাবে খাপ খাওয়াতে পারেন সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। তাই তাদের বিষয়ে বেশি করে ভাবতে হবে। কারণ কৃষকরাই দেশের প্রাণ। তারা সঠিকভাবে তাদের কাজ করতে পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবে দেশ।

 

লেখক : সাংবাদিক

ংযধযধফধঃৎধহধ৩১—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads