• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

মায়ের অবদান

  • সাধন সরকার
  • প্রকাশিত ১৮ মে ২০১৯

আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট ও জগদ্বিখ্যাত মনীষী আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, ‘আমি যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু হয়েছি অথবা যা হতে আশা করি, তার জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী।’ ‘মা’ নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসার আদর্শ। পৃথিবীতে মায়ের মতো আপন আর কেউ নেই। সবার উপরে ‘মা’। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্য সব ধর্মে মাকে পার্থিব সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে।

মা ছাড়া পৃথিবীতে সন্তানের অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। আমাদের যা কিছু তা এককথায় মায়েরই অবদান। জন্মদান, লালন-পালন, বেড়ে ওঠা, মানুষের মতো মানুষ করে তোলা, এগিয়ে চলার পথে মা-ই আমাদের সব দায়িত্ব পালন করেন। মায়ের প্রতি চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে সন্তানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। কিন্তু আমরা কি মায়ের প্রতি অনুগত বা কৃতজ্ঞ থাকছি? দেখা যায়, অনেক মা জীবনের শেষ সময়ে তথা বৃদ্ধ বয়সে এসে অবহেলার পাত্র হন! অনেক মা নিজ সন্তানের দ্বারা দুর্ব্যবহারের শিকার হন। কিন্তু আসলেই কি কোনো সন্তান মায়ের প্রতি দুর্ব্যবহারের যোগ্য! বৃদ্ধ বয়সে মায়ের জায়গা কেন বৃদ্ধাশ্রমে হবে? পৃথিবীতে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে ছাড়া কমছে না! বাংলাদেশেও বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে! জীবনের শেষ সময়ে সন্তানের কোল ছেড়ে যখন কোনো মাকে বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হয় বা বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসা হয়, তখন সেই মায়ের পাহাড়সম কষ্ট ওই মা ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারে না।

মা শতকষ্টে থাকলেও কিংবা সন্তানের দ্বারা কষ্ট পেলেও কোনো মা কখনো সন্তানের খারাপ চান না। দিনের পর দিন বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট কক্ষে থেকেও সন্তানের পাশে থাকার আকুতি কিংবা পাশে পাওয়ার মিনতি মায়ের হূদয়কে কুরে কুরে খেলেও স্নেহময়ী মা এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেন যে, সন্তান একদিন আসবে! হয়তো বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের বাড়ি বা বাসা বেশি দূরে নয়। কিন্তু মনে হয়, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়ের সঙ্গে নাড়ি ছেঁড়া ধনের যোজন যোজন ব্যবধান! কী আজব জীবন!

পত্রিকার পাতায় বা  টেলিভিশনের পর্দায় অনেক সংবাদ দেখে শিউরে উঠি! দেখা যায়, কোনো সন্তান তার মাকে রেললাইনে ফেলে রেখে গেছেন, কোনো সন্তান তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে এসেছেন। আবার শোনা যায় কোনো মা সন্তানের অবহেলার শিকার, আবার কোনো মা বাঁচার তাগিদে ভিক্ষা করছেন। এমনসব উদাহরণের কথা অনেক বলা যাবে!

অনেক সময় আবার দেখা যায়, সন্তানরা বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, বাড়ি-গাড়ি আছে অথচ মাকে  দেখার মতো সময় সেসব সন্তানের হয় না! এমনও অনেক মা আছেন, যাদের সন্তানসন্ততি উচ্চশিক্ষিত, দেশে-বিদেশে ছেলে-মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত অথচ মাকে সময় দেওয়ার মতো সময় তাদের মেলে না! বৃদ্ধাশ্রমে গেলে এমনও ঘটনা জানা যায়, মা যে শহরে বা এলাকায় বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানসন্ততি পরিবার নিয়ে ওই শহরেই বা আশপাশে থাকেন অথচ মাসের পর মাস অতিবাহিত হলেও মাকে দেখার সময় পান না! এতকিছুর পরেও শতকষ্টে, অনাদর-অবহেলায় থাকলেও কোনো মা কখনো একটিবারের জন্য সন্তানের খারাপ চান না। লোকেমুখে বলতে শোনা যায় যে সন্তান তার মায়ের দেখভাল করে না, শেষ বয়সে তার সন্তানও তার খোঁজখবর রাখবে না! জানি না একথা কতটুকু সত্য!

আমরা যদি আমাদের মা-বাবার যত্ন না নিই, দেখাশোনা না করি তাহলে আমরা যখন বৃদ্ধ হবো আমাদের সন্তানরাও কি আমাদের দেখাশোনা করবে? পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে অথচ মায়া-মমতা-ভালোবাসা যেন কমে যাচ্ছে! সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা বেড়েই চলেছে! লোভ-লালসার কাছে সবকিছু যেন হার মেনে যাচ্ছে!  যৌথ পরিবারের সংখ্যা এখন হাতে গোনা! পারিবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে। শুধুই ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা! এখন দেখা যায়, নিজের ছোট ছোট সন্তানসন্ততি, বৃদ্ধ মা-বাবা তথা পরিবারের সদস্যদের সময় দেওয়ার মতো অনেকে সময় পান না। অনেকেই শুধু টাকার পেছনে ছুটছে!

অথচ আমরা এটা ভেবে দেখছি না যে, শুধু টাকা দিয়ে সবকিছু অর্জন করা যায় না। পরিবারের মা-বাবা যদি অনাদার-অবহেলায় থাকে, সন্তানসন্ততি স্নেহ-ভালোবাসা না পেয়ে যদি বখে যায়, বিপথে যায় তখন শতকোটি টাকা দিয়েও ভালোবাসা, বন্ধনের জায়গাগুলো আর ফিরে নাও আসতে পারে। আমরা শিক্ষিত হচ্ছি বটে; কিন্তু কোন ধরনের শিক্ষা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? নকল চাকচিক্য, আকাশ সংস্কৃতির প্রসার, প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণহীন উন্নয়নে আমরা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি না তো! প্রযুক্তির অবাধ প্রসারের এই সময়ে আমরা প্রতিদিন যতটা সময় প্রযুক্তির সঙ্গে থাকছি, তার দশ ভাগের এক ভাগও কি মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি?

অতিসম্প্রতি পরিবারের ‘বৃদ্ধ মা-বাবার ভরণপোষণ আইন’ পাস হয়েছে। শুধু আইন-ই একমাত্র সমাধান নয়! কেননা বৃদ্ধ বাবা-মাকে যদি সন্তান ভরণপোষণ করতে না চায়, তারপরও মনের কষ্টে ললাটলিখন মেনে নিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা সন্তানের খারাপ চান না, ছেলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে চান না! মা-বাবার দোয়া পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। মানবসন্তান হিসেবে প্রত্যেক সন্তানেরই অপরিহার্য কর্তব্য পিতা-মাতার সেবা-যত্ন করা। মা-বাবাকে ভালো না বাসলে সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসার দরজাও তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়।

 

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads