• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ধর্ষণের মূল কারণ বিচারহীনতা

প্রতীকী ছবি

মতামত

ধর্ষণের মূল কারণ বিচারহীনতা

  • প্রকাশিত ১০ জুলাই ২০১৯

‘ধর্ষণ কোনো আধুনিক ব্যাপার নয় এবং বিশেষ কোনো সমাজে সীমাবদ্ধ নয়। তবে কোনো কোনো সমাজ বিশেষভাবে ধর্ষণপ্রবণ, আর কোনো কোনো সমাজ অনেকটা ধর্ষণমুক্ত; যদিও সম্পূর্ণ ধর্ষণমুক্ত সমাজ ও সময় কখনোই ছিল না, এখনো নেই। পৃথিবীতে পৌরাণিক কাল আর নেই। দেবতারা আর ধর্ষণ করে না, তবে দেবতাদের স্থান নিয়েছে পুরুষেরা। প্রায় অবাধ ধর্ষণ চলছে আজ পৃথিবীজুড়ে। ধর্ষণ আজ দেখা দিয়েছে মারাত্মক মড়করূপে। আমেরিকার মতো শিল্পোন্নত সমাজে যেমন চলছে ধর্ষণ, তেমনি চলছে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত সমাজে। বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে ধর্ষণপ্রবণ সমাজের একটি। মনে হচ্ছে পৌরাণিক দেবতারা আর ঋষিরা দলবেঁধে জন্মলাভ করেছে বাংলাদেশে।’ হুমায়ুন আজাদের এ কথাগুলো আজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ এখন ধর্ষণের রঙ্গমঞ্চ।  

পত্রপত্রিকা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের কল্যাণে শুধু চোখ বোলালেই শত শত ধর্ষণের খবর দেখা যায়, কিন্তু ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে আহামরি তেমন কোনো শাস্তি দিতে দেখা যায় না। একজন ধর্ষণকারী এবং একজন খুনির মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। একজন খুনির যদি সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে, তবে একজন ধর্ষকের কেন নয়? সৌদি আরবে খুন আর ধর্ষণের শাস্তি কতটা ভয়ানক তা আমরা সবাই কমবেশি হলেও জানি এবং না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। ভোগবাদী সমাজে নারীমুক্তির স্লোগানের আড়ালে নারীরা চিরকালই ভোগের পণ্য? উন্নত দেশেও ধর্ষণ হয়, অপরাধ হয়। তবে সে দেশে অপরাধের অন্তত বিচার হয়। আর আমাদের দেশে অপরাধী রাজার হালে বুক ফুলিয়ে, কলার উঁচু করে বীরের বেশে এলাকায় ঘুরে বেড়ায়; আর ধর্ষিতার স্থান হয় নির্জন ঘরের কোণে— যদি সে বেঁচে থাকে!  

যৌনতা কখনো শিক্ষা হয়ে ধরা দেয়নি, নারী কখনো মানসী হয়ে ওঠেনি। যৌনাচার কখনো সভ্যতা রূপে আসেনি, নারী কখনো সঙ্গী হয়ে ওঠেনি। পুরুষ নারীদের যৌনসঙ্গী মেনে নিয়েছে, জীবনসঙ্গী নয়। সৃষ্টির আদি থেকে নারী-পুরুষের মধ্যে লৈঙ্গিক সম্পর্ক আছে, মানুষের সম্পর্ক ক্ষণে ক্ষণে কালে কালে ভেঙে পড়েছে বারবার। ধর্ষণ শুধু নারীর দেহপ্রাপ্তি হলে নিরীহ পশুপাখিরাও মানুষের ধর্ষণের স্বীকার হতো না। যে ধর্ষণ করবে সে বোরকা ছিঁড়েও ধর্ষণ করবে, লোহার অন্তর্বাসও তাদের ঠেকাতে পারবে না। ধর্মের দোহাই দিয়ে বাসনা দমন করা যায়, নিবারণ করা যায় না। মানুষ যেমন ধর্ষক হয়ে জন্মগ্রহণ করে না, তেমনিভাবে হঠাৎ করে একজন মানুষ ধর্ষকের ভূমিকায় নামতে পারে না। শুধু ধর্ষকাম, রতিসম্ভোগ ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়। এর পেছনে দীর্ঘ পারিবারিক, মনোসামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাস থাকে যার সূত্রপাত ঘটে ছেলেবেলায়। এ পৃথিবীটা পুরুষতান্ত্রিক। তাই ধর্ষণে পুরুষরাই অগ্রগামী। তবে, নারী কর্তৃক ধর্ষণ কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক সমাজে মেয়েরাও পুরুষকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে, জোর করে নারী সমকামিতায় লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে কিছুটা এর প্রভাব আছে। ধর্ষণ কেবল যৌনসম্ভোগ হলে তিন বছরের মেয়ে, পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা ধর্ষিত হতো না। 

মনুষ্য চেতনার যে স্তরে মানুষ ধর্ষণে প্রবৃত্ত হয়, সে স্তরে কোনো নীতিবোধ কাজ করে না, কোনো ধর্মের দোহাই চলে না, কোনো আইনের ভয়ও নেই সেখানে। আইন করে আইনের কঠোর প্রয়োগ করলেই ধর্ষণকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, বন্ধ করা যাবে না। সুতরাং নারী, পুরুষ নির্বিশেষে যৌন উত্তেজক ওষুধ/মাদক/পানীয়ের অবাধ বিচরণ রুখতে হবে; যৌন আবেদনমূলক যেকোনো ধরনের শিল্প-কলা-সাহিত্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; অবাধ ইন্টারনেটের যুগে যতটা সম্ভব পর্নোসাইট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইলের মাধ্যমে পর্নো যেন সবার হাতে হাতে না পৌঁছতে পারে, সে বিষয়েও লক্ষ রাখতে হবে।  

ধর্ষণ একপ্রকার যৌন অত্যাচার। উদ্বেগজনক বিষয় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বাচ্চাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। প্রতিটি সূচকেই বছরের পর বছর শিশুর প্রতি নিপীড়ন বেড়েই চলছে। সংবাদপত্রে যেটা প্রকাশ হয়, আসলে ঘটনা তার চেয়েও অনেক বেশি ঘটে। কিন্তু এগুলো জানা যায় না, কারণ মানুষ সহজে মামলা করে না কিংবা পুলিশের কাছে যায় না। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের করার পর খুব কম ক্ষেত্রেই বিচার হয়। মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করলেও এসব মামলার বিচার হয় না ঠিকমতো এবং লুকানোর প্রবণতা থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের সঠিক হিসাব পাওয়াও যায় না। এই সুযোগে অপরাধীরা মনে করে, তাদের শাস্তি হবে না। শাস্তি হচ্ছে না বলেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড দাবি করেছে। গত বছর মোট ১ হাজার ২৫১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২২৪ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৮ জন নারীকে। গত বছর ধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ২৩৫টি। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তবে সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় আছে, ‘ধর্ষণ বা পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে।’ একই সঙ্গে সর্বনিম্ন জরিমানা ১ লাখ টাকা এবং ৯(৩) ধারায় আছে, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্ত ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু মারা যায়, তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড ও কমপক্ষে ১ লাখ টাকা জরিমানা হবে।’ আইনটি কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ নেই বললেই চলে। 

আমি মনে করি বিচারহীনতা বা দায়মুক্তির সংস্কৃতি সবচেয়ে বড় কারণ। মূল্যবোধের অবক্ষয় তো আছেই। দীর্ঘদিন বিচারপ্রক্রিয়ার কারণে দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিয়ে আস্থা নেই মানুষের। পাশাপাশি ধর্ষণের এই ব্যাপকতার পেছনের ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে না চলা এবং অপরাধীর শাস্তি না দেওয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততাও যথেষ্ট দায়ী। আর এসব কারণেই ধর্ষণ বাড়ছে বৈ কমছে না। ধর্ষণ প্রতিরোধ এখন আইনের কঠোর প্রয়োগ খুবই জরুরি।  

হাদিউল হৃদয়

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads