• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষিতরা

প্রতীকী ছবি

মতামত

আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষিতরা

  • প্রকাশিত ২৪ অক্টোবর ২০১৯

অবারিত শিক্ষার দ্বার আজ সময়ের গণ্ডিতে রুদ্ধ যেন, শিক্ষার্থীতে পূর্ণ থাকে শিক্ষালয় আর শিক্ষালয় থাকে শিক্ষকশূন্য। বাণিজ্যিকীকরণের পক্ষে চলে লাগামহীন যুক্তি আর শিক্ষার ঘটে অপমৃত্যু। এমন যখন আমাদের চারপাশ, চলছে প্রকৃত শিক্ষার অবদমন; তখন প্রয়োজন সমাজ বিনির্মাণের শিক্ষক। সেই সমাজ-শিক্ষকের আজ বড় অভাব। অথচ সেই সমাজ-শিক্ষক গোবরে পদ্মফুলের মতো লুকিয়ে আছে এই সমাজেরই অভ্যন্তরে, খালি চোখে আমরা তাকে দেখতে পারি না অথবা দেখতে চাই না।

পাঁচ ছয় বছর আগে নিতুকে নিয়ে বাজারে গিয়ে এক ভিক্ষুকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ভিক্ষুকের ছোট্ট বাচ্চাটি নিতুকে রুটি সেধে বলছিল, এটা তুমি খাও। অবাক হয়েছিলাম ভিক্ষুকের শিশুটির আচরণে। শিক্ষিত মানুষগুলোকে দেখি আর তাদের শিশুদেরও দেখি। বেশিরভাগ শিশুর কেউই অন্যকে কিছু দিতে চায় না এবং বাবা-মায়েরাও শেখায় না। সেক্ষেত্রে ভিক্ষুকের শিশুটির আচরণ আমাকে সেদিনই ভাবিয়ছিল।

তারপর অনেক দিন গেছে। এখনো দিন যাচ্ছে। পথের শিশু নিয়ে ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়েছি। কী হবে এদের? জাতি এই পথশিশুদের কীভাবে সামলাবে? কারণ একটাই- তাদের বেশিরভাগ ছিন্নমূল হয়েই বাঁচে। একসময় নেশাখোর হয়, কন্যাশিশুদের পতিতালয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। রাজপথের অনেক গল্পের সঙ্গে শিশুদের জীবন হারিয়ে কৈশোরেই এরা হয়ে ওঠে, হয়ে উঠতে বাধ্য হয় পূর্ণাঙ্গ মানুষ! চোখের জলে ধুয়ে যায় ছোটবেলার অসাধারণ মনুষ্যত্ব! যে বাচ্চাটি নিতুকে ওভাবে খাবার সেধেছিল, সে বাচ্চাটিও হয়তো এভাবেই হারিয়ে গেছে অকারণে!

অযত্নে হারিয়ে যাওয়া হাজার ফুলের খোঁজ কেউ রাখে না। কিন্তু আমাদের সন্তানরা কত সুযোগ-সুবিধা পায়, কত খাবার খায়, কত আদর পায়! অথচ জীবন উপলব্ধির ক্ষেত্রে তাদের বিচারিক ক্ষমতা আমরা কতটা দিতে পারি বা সামর্থ্য হই! স্কুল, মক্তব অথবা পাঠশালা যা-ই বলি না কেন, যারাই এই সম্মানিত জায়গাগুলোতে গমন করে তারা অন্যরকম হবে, এই প্রত্যাশায় আমরা প্রতিনিয়ত যে ভাবনাগুলো ভেবে যাই— তার ছেদ পড়ে যাচ্ছে অহর্নিশ। আবরারের কথা উল্লেখ করতেও যেন মাথা লজ্জায় নুইয়ে আসে। রাষ্ট্র বিচারের সব ব্যবস্থা করছে এখন, সবাই তৎপর হয়েও গেছে। কিন্তু প্রশ্নটা ওখানে নয়, প্রশ্নটা হলো কী করে মানুষ এমন নিষ্ঠুর হতে শিখল? সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকেও! আবরারের মৃত্যু এবং তাকে যারা হত্যা করেছে পুরো বিষয়টিই মাথা থেকে ঝেরে ফেলা যাচ্ছে না। তার পরেও ঘটে গেল আরো কতগুলো খারাপ ঘটনা!

বগুড়ায় মুক্তিযোদ্ধা বাবার কবরের ওপর সন্তান টয়লেট নির্মাণ শুরু করেছিল। সেটার সংবাদ আমরা দেখেছি। আবার আরেকটি শিশুর ক্ষতবিক্ষত ঝুলে থাকা ছবি দেখে মনে হয়েছে আমাদের মানবিক অস্তিত্বই বুঝি শেষ হলো। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার এ নৃশংস ঘটনাটি মস্তিষ্কের নিউরনগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে যেন! আসলে আমরা কী ধরনের অমানবিক হয়ে উঠছি- এটার কোনো ঘৃণিত সংজ্ঞাও বুঝি এখন আর দাঁড় করানো সম্ভব নয়। বাবা কেমন থাকেন একটি সংসারে, এই প্রশ্নের উত্তর সেই কুলাঙ্গার সন্তান হয়তো দিতে অক্ষম, কিন্তু রাষ্ট্র? শিশুর এমন মৃত্যু যে কোনো পাষণ্ড মানুষও দেখতে অক্ষম। কিন্তু তাও আমাদের দেখতে বাধ্য করা হলো! এমন বিবেক বিবর্জিত মানুষগুলোকে রাষ্ট্র কী করবে?

নৈতিকতার মহাবিপর্যয়ে আমরা এখন যা পারি তা হলো শুধু আর্তনাদ করা। তাতেই কি আমরা অদূর ভবিষ্যতে একটু সভ্য, সবুজ, সুন্দর মানুষ পাব? বুয়েটের মতো মেধার চাষের জায়গায় অনৈতিক আচরণেরও চাষ বাড়ছে। রাষ্ট্রের কাছে আবেদন, যে সন্তান মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সেই সন্তান এমন ঘৃণিত কাজ করেও সরবে ঘুরবে এটা আমরা দেখতে চাই না। একটা ঘড়ি আর একটা রেডিও নিয়ে দিন পার করা আমাদের সেই সময়টা বিনোদনে ভরা ছিল। ক্ষুধা আর বিনোদন দুটি দুপাড়ের বিষয় হলেও আমাদের সময় বিনোদন বলতে যখন একটি প্রিয় কোনো গান শুনে সময় কাটানোই ছিল অধিক প্রাপ্তির, তখন আমরা মানবিক হয়ে উঠতাম অভাব থেকে মুক্ত হওয়ার চিন্তা করতে করতে। অন্যের অভাব বুঝতাম নিজের অভাবের মধ্য দিয়ে। এখন সব পাচ্ছে সবাই, অথচ বোধের প্রান্তীয় অঞ্চলে বিকাশের জায়গায় ছোটবেলা থেকেই বেশি কিছু পাওয়ার হইহুল্লোড় কেড়ে নিয়েছে সামান্য মানবতা।

আজ হিসাব মেলানোর সময় নেই। পিঠাপুলির দিন গেছে, একসঙ্গে পল্লীবর্ষা কাটানোর দিন গেছে, একটি বাংলা ছায়াছবি দেখার জন্য এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার সুখস্মৃতির সেই দিন আজ নেই। বিনিময়ে এসেছে এমন একটি সময়, যেখানে আছে শিক্ষা শিক্ষা করে চিৎকার করার দিন, দুর্নীতি নিয়ে একপক্ষের অর্থ কেড়ে নেওয়ার দিন আর মানবতা থেকে দূরে সরে গিয়ে বিধ্বংসী হয়ে যাওয়ার দিন!

তবে একটা ভালো সংবাদ দিই, সেটা হলো- আমরা এখনো বুঝতে পারি আমাদের কেমন আচরণ হওয়া উচিত, এখনো কেউ কেউ সম্প্রীতির কথা বলে, কেউ কেউ সন্তানকে বলে তুমি ভালো মানুষ হও। কিন্তু খারাপ সংবাদ হলো, আমরা যেখানে সবটুকু বিশ্বাস নিয়ে সন্তানদের আরো ভালো মানুষ করার জন্য পাঠাই, সেখানে হায়েনারা বসবাস শুরু করেছে। তারা যে পরিবারগুলো থেকে এসেছে, তাদের পরিবারেও বাবা-মা থাকে কিন্তু তারা হয়তো তাদের সন্তানদের ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন খারাপ কাজগুলো করা থেকে!

এখন এগুলো লিখতেও ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে একটি ফুল হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে, হতে ইচ্ছে করে সুপারম্যানের মতো হয়ে সবার কাছে গিয়ে মানবতার গান শোনাতে। হয়তো মানুষ হয়ে উঠতে পারলে এত অশান্তি থাকত না। শিক্ষা মনের ভেতর নিতে পারলে এত নিষ্ঠুর অমানবিক হওয়া সম্ভব নয়। সবাই ভিক্ষুকের সন্তানের মতো নিজের খাওয়া রুটিটিও দিয়ে দেওয়ার মতো মানবিক হয়ে উঠতে পারলেই কেবল আমরা হতাম শান্তিতে পরিপূর্ণ!

আসুন, নৈতিকতার চাষ শুরু করি প্রতি ঘর থেকে। সন্তানকে ভালো মানুষ তৈরি করতে বিনিয়োগ করুন আপনার সময়, শিক্ষা এবং ভালোবাসা। অনেক ভালো স্কুলের আগে নিশ্চিত করুন অনেক ভালো বাড়ির পরিবেশ। সন্তান মানুষ না হলে এমন অনৈতিকতা বাড়তেই থাকবে। আর তার প্রধান দায় নিতে হবে পরিবারকেই। সেই অনলে পুড়ে পুড়ে নিজের দংশন নিজেকেই দেখতে হবে। পারবেন কি তা সহ্য করতে?

সাইদ চৌধুরী

লেখক : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি

শ্রীপুর, গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads