• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
অবিকৃতভাবে টিকে থাকুক বাংলা ভাষা

ফাইল ছবি

মতামত

অবিকৃতভাবে টিকে থাকুক বাংলা ভাষা

  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

শুরু হয়ে গেল ভাষার মাস। বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে ভাষার জন্য আলাদাভাবে একটি দিবস পালন করা হয়। মাসব্যাপী ভাষার মাস হিসেবে পালন করা হয় ফেব্রুয়ারি মাসকে। এই গ্রহের অন্য আরো দুই শতাধিক দেশ যা করে না, তা আমাদের করার যুক্তিসঙ্গত কিছু কারণও আছে। কারণ আমরাই একমাত্র জাতি, যে জাতির অনেক সূর্যসন্তান ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন। বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়ে তবেই আমরা অর্জন করেছিলাম বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার। আমরা সবাই জানি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাস্তায় নামলে শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ জাতির আরো অনেক সূর্যসন্তান। কিন্তু আমরা সেদিনও বাংলা ভাষায় কথা বলার সাংবিধানিক অধিকার পাইনি। তবে সেদিন থেকেই বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার দু’বছর পর ৭ মে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয় তারও দু’বছর পর ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে। অর্থাৎ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেতে বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষাকে পরিচিত করাতে আমাদের চার বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল।

জাতি হিসেবে আমরা এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পেরেছিলাম, ধৈর্য ধারণ করেছিলাম, জীবন দিয়েছিলাম শুধু ভাষার প্রতি আমাদের অগাধ সম্মান আর ভালোবাসা ছিল বলে। আজ একুশ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় বিশ্বের প্রতিটি দেশে। এই দিনটিকে স্মরণীয় করেছিলাম আমরা বাঙালিরাই। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষাকে উপস্থাপন করেন। আমরা ১৯৭১ সালে জাতির পিতার নেতৃত্বে যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, সে যুদ্ধে আমাদের অনেক সাহস আর উৎসাহ জুগিয়েছিল বায়ান্নর সেই ভাষা আন্দোলন।

এই যখন আমাদের বাংলা ভাষার ইতিহাস তখন জাতি হিসেবে আমাদের গর্ব করা উচিত বাংলা ভাষার জন্য। আমরা গর্ব যদি করেও থাকি, অন্তত আমাদের ভাষার মূল্যায়নটি সঠিকভাবে করতে পারছি না। আমাদের একটি সহজ, সরল এবং শ্রুতিমধুর ভাষা থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত আমরা একে জটিল ও শ্রুতিকটু করে ফেলছি। এ কাজটা হয়তো আমরা সচেতনভাবে কিংবা অসচেতনভাবেই করছি। কিন্তু আমাদের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত ছিল অথবা এখন হওয়া উচিত। বাংলা ভাষার সঙ্গে হিন্দি, ইংরেজি আরো নানা ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়ে প্রতিনিয়ত একে বিকৃত করা হচ্ছে, যেটা কোনো সুস্থ মানুষের কাম্য নয়। পৃথিবী থেকে ইতোমধ্যে কিছু কিছু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে আবার কিছু ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত না হলেও অন্তত বিকৃত যে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে বাংলা ভাষার বিকৃতি কিংবা বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার মিশ্রণ এখন আর কোনো বড় বিষয়ই নয়। দেশের নামকরা টিভি চ্যানেলগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপকরা যখন বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন এবং অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরাও এ ধরনের ভাষায় কথা বলেন তখন বাকিদের কাছে কি বার্তা পৌঁছায়?  ভাষাকে বিকৃত করা কি কোনো অপরাধ নয়?

আজকাল দেখা যায় তরুণ প্রজন্মের অনেকেই শুদ্ধ বাক্য এবং শুদ্ধ বানানে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের মতামত তুলে ধরতে পারেন না। অনেক শিক্ষিত লোকও ভুল বানান এবং অশুদ্ধ বাক্য ব্যবহার করে থাকেন। আমরা যে বাংলা ভাষাকে শুধু ভুলভাবে ব্যবহার করছি কিংবা বিকৃত করছি তা-ই নয়, আমাদের কারো কারো মধ্যে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার না করার প্রবণতাও বিদ্যমান। আমাদের দেশের প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকান ইত্যাদির নাম করা হয় ইংরেজিতে। কিন্তু আমরা চাইলেই সুন্দর কিছু বাংলা নামে এসব প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করতে পারি। প্রতিনিয়ত ইংরেজি শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হয়ে চলছে। সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষা কিছুটা পিছিয়ে আছে বলতে হবে। বর্তমান বহুল ব্যবহূত কিছু কিছু ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা ব্যবহার করা কখনো কখনো একটু কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বাংলা ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করার দিকে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।

বাংলা ভাষাকে বিকৃত করা কিংবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার না করার প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এই ভাষা আমাদের। তাই এই ভাষাকে অবিকৃতভাবে সংরক্ষণ করার দায়িত্বও আমাদের। এজন্য আমাদের শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে হবে এবং শুদ্ধ বানানে লিখতে হবে। বিভিন্ন স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ ইংরেজিতে না করে বাংলায় করতে হবে। কথা বলার সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিদেশি শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার সময় আমাদের সচেতন হতে হবে; আমরা যেন মজা করতে গিয়ে ভাষাকে বিকৃত করে না ফেলি। এটিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিংবা প্রকাশ্যে বাংলাভাষা বিকৃত করাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি-না, সেটি সরকার কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারেন। এতে বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারে সবাই সচেতন হবে বলেই ধারণা।

শুরু হয়ে গেছে একুশের বইমেলা। আমাদের উচিত বেশি বেশি বাংলা ভাষার বই কেনা এবং পড়া। এতে একদিকে যেমন আমাদের বাংলা ভাষার শব্দের ভান্ডার সমৃদ্ধ হবে, তেমনি আমাদের মাঝে শুদ্ধ ও সুন্দর উচ্চারণে বাংলা ভাষায় কথা বলার ও লেখার অভ্যাস গড়ে উঠবে। পাশাপাশি বইয়ের আলোয় আলোকিত হবে মন। সে আলো ছড়িয়ে পড়ুক চারদিকে। একটি সুন্দর এবং স্থিতিশীল সমাজ বিনির্মাণে যে আলোর বড়ই প্রয়োজন।

লেখক : আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

শিক্ষার্থী

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads