• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

বিশ্বায়নে আরবি ভাষার গুরুত্ব

  • মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০১৮

মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা ব্যবহার করে থাকে। পৃথিবীতে যেদিন মানুষের আবির্ভাব ঘটে, সেদিন থেকেই তার মুখে ফুটে ওঠে ভাষা। প্রথম সৃষ্ট মানব-মানবী হজরত আদম ও হজরত হাওয়া (আ.)-কে জান্নাতে পরীক্ষার জন্য সর্বপ্রথম যে শব্দজ্ঞান ও ভাষা শেখানো হয়েছিল তা হলো আরবি, এতে কোনো দ্বিমত নেই। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, জান্নাতে হজরত আদম (আ.)-এর ভাষা ছিল আরবি। কিন্তু ভুলবশত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার পর তিনি আরবি ভাষা ভুলে যান। এরপর যখন তওবা কবুল করা হয়, তখন থেকে পুনরায় আরবি ভাষায় কথা বলতে সক্ষম হন  (আল ইতকান ফি উলুমিল কোরআন : ১/১৩৬)। হজরত আদম (আ.)-এর সন্তানরা মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে সভ্যতা গড়ে তোলে, তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই আরবি ভাষা।

আরবি ভাষা বিশ্বের একটি পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা, সেই সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। জাতিসংঘ যে কয়টি ভাষার অনুমোদন করেছে, আরবি তার মধ্যে চতুর্থ। ফলে আরবি ভাষার প্রয়োগক্ষেত্র দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আরবি ভাষার প্রয়োগ তুলনাহীন। আরবি ভাষাভাষী রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে অবশ্যই আরবি ভাষা জানতে হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন প্রসাধনসামগ্রী, খাদ্য ও পানীয়, দৈনন্দিন ব্যবহার্য নানান বস্তু, বাচ্চাদের খেলনা, গাড়ির পার্টসসহ অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মোড়কে ইংরেজি বা অন্য ভাষার পাশাপাশি আরবি লেখা হচ্ছে। সম্প্রতি আরবি ভাষার প্রয়োগক্ষেত্র আরো বেড়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রচারমাধ্যমগুলো নিয়মিত আরবিতে সংবাদ পরিবেশন করছে। অন্যান্য পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের মতো এখন আরবিতেও পত্রিকা ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে।

আরবি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা। কেননা আরবি ভাষা ছাড়া মানুষ জ্ঞানকে পরীক্ষা করতে পারে না। দ্বীনের ব্যুৎপত্তি জ্ঞান অর্জন করতে হলে আরবি ভাষার বিকল্প নেই। মধ্যযুগ তথা আব্বাসীয় আমলে মুসলমানরা যখন একের পর এক এলাকা জয় করতে থাকে এবং বিভিন্ন জ্ঞান ও কৃষ্টিকালচারের সম্মুখীন হয়, তখন তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা গবেষণা ও অনুশীলন শুরু করে। ফলে তারা গণিত, চিকিৎসা, দর্শন, তর্ক, ভূগোল শাস্ত্র আবিষ্কার করে। আরবি ভাষা কেবল গদ্য আর পদ্যে সীমিত নয়; বরং এ ভাষায় রচিত হয়েছে ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজকর্ম, শিল্পকলা, রসায়নবিদ্যা ইত্যাদি। আরবি ভাষা ইতিহাস ঐতিহ্যের ভাষা। ইসলামকে জানতে হলে সর্বপ্রথম যাদের কাছে ইসলাম এসেছে, তাদের অবস্থা ভালোভাবে জানতে হবে। আরব দেশ যেহেতু ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু, সেহেতু ইসলামকে জানার জন্য আরবদের ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে হবে। মোদ্দাকথা ইতিহাস জানতে হলে আরবি ভাষা শিখতে হবে।

ধর্মীয় দিক থেকে আরবি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। সালাত, সওম, জাকাত, হালাল-হারাম, জায়েজ-নাজায়েজ এগুলো জানা এবং পালন করা মানবজাতির ওপর অবশ্যকরণীয়। আর এগুলো জানার মাধ্যম হলো কোরআন-হাদিস। জ্ঞানের উৎসসূচক এ দুটির মাধ্যম হলো আরবি। তাই কোরআন-হাদিস বুঝতে হলে আরবির বিকল্প নেই।

মানুষের একমাত্র আইন বা বিধান হলো আল-কোরআন, যার ভাষা আরবি। মানুষ জীবনের চলার পথে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়, যার জন্য বিভিন্ন মাসআলা জানা প্রয়োজন আর মাসআলা সংক্রান্ত গ্রন্থ হলো ফিকহ ও উসূলে ফিকহ। এসব গ্রন্থও আরবি ভাষায় রচিত। জান্নাতিদের ভাষা আরবি। মুমিনের চিরকাম্য হলো জান্নাত। তাই জান্নাতের ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা শিক্ষা করলে ওই জ্ঞান পরিপক্ব হবে না।

বর্তমান বিশ্বে হাজার হাজার ভাষা রয়েছে; রয়েছে বিচিত্র বর্ণের ও গোত্রের মানুষ। সময়ের পালাবদলে ভাষারও শৈল্পিক বিবর্তন হয়েছে। ভাষার এ বৈচিত্র্য হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু এ স্বাভাবিকতার মধ্যে অস্বাভাবিক বিশ্বের সর্বপ্রাচীন ভাষা আরবিও আজ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের প্রায় সর্বত্র। কালের স্রোত, সময়ের আবর্তন কোনো কিছুই আরবি ভাষার অবিচল ও অবিশ্রান্ত গতিধারাকে স্তব্ধ করতে পারেনি।

আসলে মুসলমানরাই আরবি ভাষার ধারক ও বাহক। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে এই আরবি ভাষাকে বিশ্বায়নের জন্য যেভাবে কাজে লাগানোর দরকার ছিল, সেভাবে তারা সর্বক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাদের মধ্যকার অনৈক্য, ভুল বোঝাবুঝি, আধুনিকতার ছদ্মাবরণে ভিন্ন জাতির গোলামি স্বীকার করাসহ আরো নানা কারণে মুসলমানরা হয়তো তাদের ভাষার প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মুসলমানদের এই উদাসীনতার পরও বর্তমান বিশ্বায়নের এমন কোনো দিক ও বিভাগ নেই, যেখানে আরবি ভাষার কদর নেই। সুতরাং আরবি ভাষা এমন এক খরস্রোতা নদীর নাম, যার চলার পথ তৈরি করতে অন্য কারো প্রয়োজন পড়ে না।

বর্তমান বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা ১৩০ কোটিরও বেশি, যা মোট জনসমষ্টির ছয়ভাগের এক ভাগ। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের অধিকাংশের ভাষাই আরবি। এ ছাড়া যাদের ভাষা আরবি নয়, তারা মুসলমান হওয়ার কারণে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আরবি ভাষা চর্চা করে চলেছে। সুতরাং এই বিপুলসংখ্যক মানুষের হূদয়ের ভাষা আরবিকে বাদ দিয়ে বিশ্বায়নের কথা কল্পনাই করা যায় না। বিশ্বে যত ভাষা আছে, তার মধ্যে আরবি ভাষা সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ। এর প্রাঞ্জলতা, সাবলীলতা, ভাবগাম্ভীর্য, নান্দনিকতা, সৃষ্টিশীলতা- সবকিছুই এ ভাষাকে বিশ্বের অন্য সব ভাষা থেকে স্বতন্ত্র মহিমায় দেদীপ্যমান করে রেখেছে। সুতরাং মর্যাদার দিক থেকে অন্যান্য ভাষার চেয়ে আরবি ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি। এমন মর্যাদাপূর্ণ ভাষার যথাযথ পরিচর্যা ও প্রয়োগ ছাড়া বিশ্বায়ন পরিকল্পনা অবান্তর।

 

লেখক : শিক্ষক, রসুলপুর জামিয়া ইসলামিয়া ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads