• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
কুমিল্লার শাহ সুজা মসজিদ : মোগল স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন

কুমিল্লার শাহ সুজা মসজিদ

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

কুমিল্লার শাহ সুজা মসজিদ : মোগল স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন

  • খায়রুল আহসান মানিক, কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০১৯

শাহ সুজা মসজিদ কুমিল্লার একটি অনিন্দ্যসুন্দর ঐতিহাসিক নিদর্শন। মোগল স্থাপত্যশিল্পের অপরূপ কারুকার্যের স্বাক্ষর বহন করছে এ মসজিদ। কুমিল্লা শহরের মোগলটুলী এলাকার গোমতী নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মোগল আমলের এ অপরূপ কীর্তিটি।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে বর্তমান কুমিল্লা অর্থাৎ পূর্বতন ত্রিপুরা জেলায় মুসলমানদের আগমন ঘটে। চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে এ জেলায় তুর্কি মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলার মুসলমান শাসন ইতিহাসকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করা হয় যেমন সুলতানী আমল, পাঠান ও বারোভূঁইয়াদের আমল এবং মোগল আমল।

মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এ জেলায় ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু হয় এবং তা মোগল আমলের মাঝামাঝি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কুমিল্লা জেলায় মুসলমান আমলের মধ্যে সুলতানী আমলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা ইমারতাদির সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। মুসলমান আমলে নির্মিত কীর্তিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই মোগল আমলের। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত বর্তমান কুমিল্লায় ত্রিপুরাধিপতিদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় ছিল।

১৬১৮ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজ্যের চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। তখন বাংলার সুবেদার ইব্রাহীম খান ফতেহ জঙ্গ ত্রিপুরা অভিযানে সৈন্য পাঠান। যুদ্ধে ত্রিপুরা বাহিনী মোগল বাহিনীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং সে সময় ত্রিপুরার রাজা যশোধর মানিক্য বন্দি হন এবং তাকে দিল্লিতে পাঠানো হয়। এভাবেই সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্য মোগলদের করায়ত্ত হয় এবং তারা উদয়পুরে একটি থানা স্থাপন করে মীর্জা নূর উল্লাহকে সেখানকার থানাদার নিযুক্ত করেন। ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর থেকে কিছু দূরে মেহেরকূলে (বর্তমান কুমিল্লা শহর) মোগলরা ঘাঁটি স্থাপন করে। এ সময় ত্রিপুরা রাজ্য মোগলদের করদ রাজ্যে পরিণত হয় এবং ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে কল্যাণ মানিক্যের সিংহাসন লাভের সময়েও ত্রিপুরা রাজ্য মোগলদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন থাকে। কল্যাণ মানিক্যের মৃত্যুর পর ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে তার ছেলে গোবিন্দ মানিক্য সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। গোবিন্দ মানিক্য শাহ সুজা মসজিদ নির্মাণ করে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত আছেন। যদিও শাহ সুজা মসজিদটির নির্মাতা এবং নির্মাণকাল নিয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। মসজিদটির প্রবেশ তোরণে নির্মাণকাল লেখা আছে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ। অন্য তথ্যমতে এটির নির্মাণকাল ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দ। এ মসজিদ নির্মাণকাল নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ থাকলেও মসজিদের গায়ের শিলালিপি হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলেননি ইতিহাসবিদরা। শোনা যায়, শাহ সুজার সৈন্যরা যেখানে শিবির করেছিল, তার নাম বর্তমানে সুজানগর আর শাহ সুজা নিজে এ মসজিদ এলাকাতেই তাঁবু খাটিয়েছিলেন। এজন্য এ এলাকার নাম মোগলটুলি।

শাহ সুজা মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫৮ ফুট এবং প্রস্থ ২২ ফুট। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব ১৫ ইঞ্চি। বারান্দার দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট। মসজিদের গম্বুজ ৩টি, প্রধান মিনার গম্বুজ ১টি। মূল মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ছোট-বড় মিনার রয়েছে ১৮টি। ২২ ফুট করে ২টি কক্ষের ওপর রয়েছে ২টি করে ৪টি মিনার। মসজিদের দুই সীমানায় ২টি বড় মিনার আছে। এ মিনার দুটি শাহ সুজার আমলের নয়। এর দু’শতাধিক বছর পরে ঝাগুা খান নামে এক ব্যক্তি বড় দুটি মিনার তৈরি করেন বলে এলাকার বয়স্ক লোকেরা দাবি করেন। মসজিদের সামনের দেয়ালে আছে ৩টি দরজা এবং ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে আছে ৩টি মেহরাব। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ ও মেহরাব অন্য দুটির চেয়ে অনেক বড়। কেন্দ্রীয় দরজাটি বাইরের দিকে কিছুটা প্রসারিত এবং এবং এর দুপাশে আছে দুটি সরু গোলাকার মিনার।

মসজিদের সম্মুখ ভাগে প্যানেল দ্বারা সুশোভিত ছিল এবং কার্নিশের ওপর ছিল ব্যাটলমেন্ট। সাম্প্রতিক সময়ে মসজিদের দুই প্রান্তে ২২ ফুট করে দুটি এবং সম্মুখ ভাগে ২৪ ফুট প্রশস্ত একটি বারান্দা নির্মাণ করায় মসজিদের আদি রূপটি বিনষ্ট হয়েছে। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে একটি সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। পুরনো অজুখানাটি ভেঙে নতুন একটি অজুখানা তৈরি করা হয়েছে, যা মূল মসজিদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অতিসম্প্রতি মসজিদের ভেতরে আধুনিকভাবে মোজাইক ও টাইলস বসানো হয়েছে। ফলে মসজিদের প্রাচীন নির্মাণশৈলী ক্ষুণ্ন হয়েছে, হারিয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক মর্যাদাও।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads