• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

কুড়িয়ে পাওয়া সম্পদ কী করবেন

  • হুসাইন আহমাদ মাজেদী
  • প্রকাশিত ১৯ এপ্রিল ২০১৯

আমরা চলার পথে অনেক সময় রাস্তাঘাটে অনেক কিছু পড়ে থাকতে দেখি। সেসব বস্তু আমরা অধিকাংশ সময়ই কুড়িয়ে পকেটে রেখে দিই বা বাড়িতে নিয়ে যাই। কিন্তু আপনি জানেন কি— কুড়িয়ে পেলেই আপনি সেই সম্পদের মালিক হয়ে যাবেন না!

এ সম্পর্কে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো বস্তু কুড়িয়ে নেয়, সে যেন তার ওপর দুজন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী রাখে, সে যেন তা গোপন না করে, পরিবর্তন-পরিবর্ধন না করে, যদি তার মালিক আসে, তাকে তার মাল ফিরিয়ে দেবে, আর যদি না আসে, তবে সেটা আল্লাহর সম্পদ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। (ইবনে হিব্বান : ৪৮৯৪)

অন্য হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, যদি কেউ কোনো পথহারা প্রাণীকে আশ্রয় দেবে, সে নিজেই ভ্রষ্ট লোক বলে বিবেচিত হবে, যতক্ষণ না সে তা প্রচার করে দেবে। (মুসলিম : ১৭২৫)

ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় : ‘কুড়ানো বস্তু’ বলতে বোঝায় এমন সম্পত্তি, যা তার মালিক থেকে পড়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে, আর অন্য কেউ তা কুড়িয়ে নিয়েছে। অথবা এমন বস্তু যা কোনো ব্যক্তি পড়ে থাকতে দেখে কুড়িয়ে নিয়েছে এবং আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছে। (ফাতহুল কাদির)

মৌলিকভাবে কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু চার ধরনের :

১. মালিকানাবিহীন অবস্থায় প্রাপ্ত কোনো বস্তু, যেমন- স্বর্ণ, রৌপ্য ও টাকা-পয়সা ইত্যাদি।

২. কুড়িয়ে পাওয়া মানবসন্তান। যাকে সাধারণত কেউ খাওয়া-পরা দেওয়ার ভয়ে কিংবা সন্দেহযুক্ত সন্তান হওয়ায় অপমানের ভয়ে কোথাও ফেলে গেছে, সেটা যে পাবে সে তাকে লালন-পালন করবে।

৩. চতুষ্পদ জন্তু, যেমন- উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি।

৪. খাদ্যজনিত বস্তু, যা রাস্তায় পাওয়া যাবে।

যে ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির মালামাল কুড়িয়ে পায় এবং মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের তত্ত্বাবধানে রাখে, তাহলে উদ্ধারকারীর ওপর নিম্নোক্ত দায়িত্বগুলো আরোপিত হবে—

১. উদ্ধারকারীর দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃত মালিকের কাছে কুড়ানো বস্তু পৌঁছে দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত সময় পর্যন্ত ঘোষণা দিতে থাকা।

২. প্রাপ্ত বস্তু সম্পর্কে যথোপযুক্ত যত্ন গ্রহণ করা উদ্ধারকারীর কর্তব্য। অবশ্য যুক্তিসঙ্গত যত্ন নেওয়ার পরও বস্তুর কোনো ক্ষতি হলে এজন্য তাকে দায়ী করা যাবে না।

৩. প্রাপ্ত বস্তু আমানত হিসেবে থাকবে, যখন উদ্ধারকারী এই মর্মে সাক্ষী রাখবে যে, সে হেফাজত করা এবং মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তা উঠিয়ে নিচ্ছে।

৪. যদি বস্তুটির মূল্য কম হয়, তাহলে কিছুদিন ঘোষণা দেবে। পক্ষান্তরে বেশি হলে এক বছর ঘোষণা দেবে। আর মালিককে খুঁজে পাওয়া না গেলে তা সদকা করে দেবে।

৫. উদ্ধারকারীর কখনোই উচিত নয় প্রাপ্ত বস্তু নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করা। তবে যদি সে নিজেই গরিব হয়, তাহলে শরিয়ত নির্ধারিত পন্থায় সে ব্যবহার করতে পারবে।

৬. নিজের অনুরূপ বস্তুর সঙ্গে কখনোই কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর মিশ্রণ করা উচিত নয়।

৭. প্রকৃত মালিককে পাওয়ার পর ওই বস্তু প্রত্যর্পণ করাও উদ্ধারকারীর দায়িত্ব, তবে যুক্তিসঙ্গত পারিশ্রমিক সে নিতে পারবে।

৮. কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসের যদি কোনো বৃদ্ধি বা লাভ হয় তবে তাও প্রকৃত মালিককে দিতে হবে।

৯. কুড়ানো বস্তু বিক্রি করা হলে নিজ পাওনা বাদে অবশিষ্ট অর্থ প্রকৃত মালিককে দিতে হবে। (হেদায়া)

যদি কুড়ানো বস্তু এমন প্রকৃতির হয় যে, মালিক তা খোঁজ করবে না, যেমন দানা বা ডালিমের খোসা অথবা এ-জাতীয় কম প্রয়োজনীয় বস্তু, তাহলে ঘোষণা করা ছাড়াই তা দ্বারা উপকৃত হওয়া বৈধ হবে।

গাড়িতে কারো কিছু পেলে যা করবেন

গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে বা লঞ্চ ডুবলে আমাদের দেশে সাধারণত যা ঘটে তা হলো, স্বার্থান্বেষী কিছু লোক এসে মানুষকে উদ্ধারের পরিবর্তে তাদের মাল-সামানা কুড়াতে থাকে। গণিমতের মালের মতো সব কুড়িয়ে নিয়ে একদিকে কেটে পড়ে। এসব মানুষ গয়নার লোভে দুর্ঘটনার কারণে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দুর্বল অসহায় মেয়েদের কান ছিঁড়তেও কুণ্ঠাবোধ করে না।

তাদের অনেকে আবার দরদি সেজে এগিয়ে আসে। মোবাইল, টাকা-পয়সা যা পায় সব হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। অথচ শরিয়তের দৃষ্টিতে নিজে গ্রহণ করার নিয়তে এসব ধরাই হারাম।

এছাড়া যাত্রীরাও অনেক সময় গাড়িতে অনেক কিছু ফেলে যায়। কেউ ছাতা, কেউবা ব্যাগ ভুলে রেখে যায়। আবার কখনো মানিব্যাগ, মোবাইল ইত্যাদিও গাড়িতে পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে মালিকের কাছে বা মালিকের গার্ডিয়ানের কাছে পৌঁছানোর নিয়তে এসব মাল নিলে সেটা বৈধ হবে। এক্ষেত্রে বিষয়টা নির্ভরযোগ্য কাউকে জানিয়ে রাখতে হবে যে, আমি এ ধরনের এই পরিমাণ মাল পেয়েছি বা কুড়িয়েছি, যাতে কারো সন্দেহ না থাকে।

যদি কেউ বিষয়টা খুলে না বলবে, তাহলে কোনো ভুয়া দাবিদার মাল নিয়ে যেতে পারে। এরপর এ মাল থেকে দায়মুক্ত হতে শরিয়তের দৃষ্টিতে কিছু প্রক্রিয়া অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। যেমন, প্রথমেই ওই মাল তার মালিকের কাছে পৌঁছানোর জন্য সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হয়। এ উদ্দেশ্যে জিনিসটির মান অনুযায়ী মোটামুটি বা ব্যাপক ঘোষণার ব্যবস্থা করতে হয়। এ দায়িত্ব যে কুড়ালো সে নিজেও নিতে পারে, অথবা নির্ভরযোগ্য কাউকে দায়িত্ব দিয়েও এ কাজ করানো যেতে পারে। যেমন থানায় জিডি করে সব মাল তাদের দায়িত্বে দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। অথবা যে কোচ বা গাড়ি থেকে মাল পাওয়া গেছে, তাদের কেন্দ্রীয় কাউন্টারে তা জমা দিয়ে গণমাধ্যমে তাদের ঠিকানা প্রচার করে দিলে সহজেই ওই মাল তার মালিকের কাছে পৌঁছতে পারবে।

যদি কখনো এমন হয় যে, কুড়ানো মাল হলো দ্রুত পচনশীল কোনো বস্তু, যেমন ফল-ফলাদি, তা মালিকের প্রতি সওয়াব পৌঁছানোর নিয়তে গরিবকে দান করে দেবে। নিজে গরিব হলে নিজেও নিতে পারবে।

মালের সংরক্ষণ ও প্রচারণা খরচ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে করবে এবং এ খরচ মালের মালিক বহন করবে। তাকে কখনো না পাওয়া গেলে ওই মাল বিক্রি করে প্রশাসন সংরক্ষণকারীর খরচ পরিশোধ করবে। আর যদি প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই এ মালের সংরক্ষণ ও প্রচারণা বাবদ খরচ করে থাকে, তাহলে ওই খরচ তার নিজের পক্ষ থেকে মালিকের প্রতি দয়া হিসেবে বিবেচিত হবে, প্রশাসন থেকে বা ওই মাল বিক্রি করে তার খরচ উদ্ধার করতে পারবে না।

এভাবে প্রচারণার পরও যদি মালিকের সন্ধান না মেলে, তাহলে যেমনটি বলা হলো, মালিকের প্রতি সওয়াব পৌঁছানোর নিয়তে গরিবকে দান করে দেবে। গরিব হলে নিজেও নিতে পারবে। তবে এভাবে দান করে দেওয়ার পরে যদি মালের মালিক এসে মাল তালাশ করে, তাহলে তাকে দানের কথা বলে বুঝিয়ে দেবে। মানতে না চাইলে তাকে ক্ষতিপূরণ যতটুকু দিয়ে সম্ভব সন্তুষ্ট করতে হবে; প্রয়োজনে সম্পূর্ণ মালের বিনিময় আদায় করে হলেও। আগের দান তখন নিজের পক্ষ থেকে বিবেচিত হবে। (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল ৪/১৬১, আল বাহরুর রায়েক ৫/২৬০)

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads