• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে মজুতদারি

  • আয়েশা মালিহা
  • প্রকাশিত ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করা আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক ব্যাপার। এ সমাজবদ্ধ বসবাস করতে গিয়ে মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে পারস্পরিক বিভিন্ন লেনদেন করে থাকেন। প্রয়োজনীয় এমন লেনদেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ব্যবসা। এ ব্যবসার মৌলিক পরিচয় হলো— এখানে একপক্ষ থাকে ক্রেতা, অপরপক্ষ বিক্রেতা। ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে পণ্য ও মূল্যের যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য একটা আদান-প্রদান হওয়াটাই ব্যবসা। তবে অনেক সময় দেখা যায়, একপক্ষ তথা বিক্রেতা বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিজের কাছে কুক্ষিগত করে রাখে। উদ্দেশ্য— পরবর্তী সময়ে চড়ামূল্যে বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন। ফলে বাজারে সেসব পণ্যের চরম সংকট দেখা দেয় ও মূল্য বৃদ্ধি পায়। একপর্যায়ে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, সেটা আর সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে না। এতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয় ও সমাজের মানুষের মাঝে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও আরো নানাবিধ সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।

বিক্রেতার এমন কর্মকে ব্যবসায়িক পরিভাষায় মজুতদারি বলে। ইসলামিক পরিভাষায় সেটাকে বলে ‘ইহতিকার’। মজুতদারি শব্দের অর্থ হচ্ছে— একচেটিয়াকরণ, একচ্ছত্র সুবিধাভোগ, মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্য ধরে রাখা ইত্যাদি। ফুকাহায়ে কেরাম এ মজুতদারির বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। তবে শর্তের কিছু তারতম্য ব্যতীত সবার সংজ্ঞা প্রায় একই। হাদিসে এ মজুতদারিকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে। আর তাই বিভিন্ন হাদিসে এ সম্পর্কে নেতিবাচক বিবরণ লক্ষ করা যায়। এক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যশস্য মজুত করে রাখল, সে আল্লাহতায়ালা থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহতায়ালাও তার থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)।

অপর এক রেওয়ায়েতে আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য মজুত করে রাখে সে অপরাধী।’ (মুসলিম)। অন্য এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানের খাদ্যশস্য ৪০ দিন মজুত করে রাখবে আল্লাহতায়ালা তাকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও দারিদ্র্য দিয়ে শাস্তি দেবেন।’ (বোখারি, বায়হাকি)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘বাজারে পণ্য আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর পণ্য মজুতকারী অভিশপ্ত হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। রাসুল-পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগেও দেখা যায়, তারা এ মজুতদারির ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। ওসমান (রা.) তার খেলাফতকালে পণ্য মজুতকরণ নিষেধ করেছিলেন। আলী (রা.) তার খেলাফতকালে মজুতকৃত খাদ্যদ্রব্য আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।

ওমর (রা.) ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুত করার ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছিলেন— আমাদের বাজারে কেউ যেন পণ্য মজুত করে না রাখে। যাদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আছে, তারা যেন বহিরাগত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সব খাদ্যশস্য কিনে তা মজুত করে না রাখে। যে ব্যক্তি শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট সহ্য করে আমাদের দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে আসে, সে ওমরের মেহমান। অতএব সে তার আমদানি করা খাদ্যশস্য যে পরিমাণে ইচ্ছা বিক্রি করতে পারবে। আর যে পরিমাণে ইচ্ছা রেখে দিতে পারবে।

এভাবে চার মাজহাবের ইমামরাও মজুতদারির ব্যাপারে কোনো শিথিলতা দেখাননি। মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাবের অধিকাংশ আলেমের মতে, মজুতদারি সম্পূর্ণ হারাম। (আল মুনতাক্বা লিল বাজি, আল মুহাজ্জাব, আল মুগনি)। আর হানাফি আলেমদের কাছে মজুতদারি মাকরুহে তাহরিমি। (হেদায়া, আদ্দুররুল মুখতার)।

তবে মজুতদারি নিষিদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে ফুকাহায়ে কেরাম কয়েকটি শর্তারোপ করে থাকেন। যেমন— পণ্য (শহরের পরিচিত বাজার থেকে) ক্রয়কৃত হতে হবে। (অর্থাৎ প্রথমত বাজার থেকে ক্রয়কৃত হতে হবে। দ্বিতীয়ত ওই বাজার থেকে ক্রয়কৃত হতে হবে, যেই বাজার থেকে সাধারণত শহরবাসীর জন্য পণ্য আমদানি হয়ে থাকে)। সুতরাং যদি কেউ তার নিজস্ব জমির উৎপাদিত ফসল মজুত করে রাখে তবে সেটা নিষিদ্ধ মজুতদারি হিসেবে বিবেচিত হবে না। এভাবে যদি কেউ দূরবর্তী বাজার তথা যেই বাজার থেকে সাধারণত সংশ্লিষ্ট শহরে খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি হয় না, সেখান থেকে পণ্য ক্রয় করে এনে জমা করে রাখে, তাহলেও সেটা নিষিদ্ধ মজুতদারি হবে না। (আদ্দুররুল মুখতার)।

মজুতদারির কারণে মানুষ ও জীবজন্তুর কষ্ট ও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে হবে। মজুতদারির উদ্দেশ্য হতে হবে ব্যবসা। সুতরাং কেউ যদি নিজ পরিবারের বার্ষিক ব্যয় পরিমাণ প্রয়োজনীয় পণ্য মজুত করে রাখে তবে সেটা নিষিদ্ধ মজুতদারি হবে না। এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে, ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তার পরিবারের জন্য এক বছরের খাদ্যসামগ্রী (তথা খেজুর) মজুত করে রেখেছিলেন। (বোখারি)

মজুতদারি চল্লিশ বা তার চেয়ে বেশি দিনের হতে হবে। এক হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্যশস্য মজুত করে রাখল সে আল্লাহতায়ালা থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহতায়ালাও তার থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন। (মুসনাদে আহমাদ) পণ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ও জিনিসপত্র, যা মানুষ ও জীবজন্তুর মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। সুতরাং এমন বস্তু না হলে সেখানে নিষিদ্ধ মজুতদারির কোনো ব্যাপার থাকবে না। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি) সে হিসেবে মজুতদারির জন্য উল্লিখিত শর্তগুলো পাওয়া না গেলে মজুতদারি বৈধ হবে।

মজুতদারির এমন ঘৃণ্যতার কারণে ইসলাম সরকারকে তা নিষিদ্ধকরণে হস্তক্ষেপ করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। ফুকাহায়ে কেরামের সর্বসম্মত মত হলো— যদি দেশে বা শহরে তুর্ভিক্ষ দেখা দেয় কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও বস্তুর চরম সংকট দেখা দেয় এবং সাধারণ জনগণের মাঝে হাহাকার লেগে যায় তবে সরকার ন্যায্যমূল্যে খাদ্যসামগ্রী ও প্রয়োজনীয় বস্তু বিক্রি করতে মজুতদারদের বাধ্য করতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে আবেদিন শামি (রহ.) তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ রদ্দুল মুখতারে লেখেন, মজুতদারির কারণে দেশে চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সরকার মজুতদার শ্রেণিকে তাদের নিজের ও তাদের পরিবারের খোরাকি রেখে অবশিষ্ট সব পণ্য ন্যায্যমূল্যে বাজারজাত করতে আদেশ প্রদান করবে। সরকারের নির্দেশ অমান্য করলে সরকার শক্তিপ্রয়োগ করে দেশের সব বাজারে সুলভমূল্যে তাদের গুদামজাত খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করবে। এমনকি অভাবের কারণে জনগণ যদি নগদ মূল্য পরিশোধ করতে অক্ষম হয়; তবে তাদের সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত মেয়াদ ধার্য করে বাকিতে তাদের কাছে খাদ্য হস্তান্তর করবে। (রদ্দুল মুখতার)।

আল্লাহতায়ালা আমাদের এ সামাজিক অপরাধ থেকে বিরত থাকার তৌফিক দান করুন।

 

লেখক : আলেম ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads