• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়

  • প্রকাশিত ১৯ নভেম্বর ২০২০

মুফতি নাঈম কাসেমী

 

 

হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের সারাটা জীবন উম্মতের নাজাতের ফিকিরে কাটিয়ে দিয়েছেন। কীভাবে প্রতিটি মানুষ ইহকাল ও পরকালে শান্তিতে থাকবে, সে লক্ষ্যেই তিনি (সা.) কাজ করেছেন। জাহান্নাম ও আল্লাহতায়ালার আজাব থেকে উম্মতকে বাঁচানোর জন্য হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্ববাসীকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নসিহত ও উপদেশ দিয়েছেন।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কখনো আল্লাহর সঙ্গে শিরক করো না। যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় অথবা আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।’ এই দুনিয়ায় একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো আল্লাহতায়ালার সঙ্গে শিরক করা। আল্লাহতায়ালা কোরআন কারীমে বলেন, ‘নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম।’ আর হাদিসে পাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু শিরক ক্ষমা করবেন না (মেশকাত শরিফ)।’ তাই শিরক থেকে বেঁচে থাকা সকল মানুষের জন্য অপরিহার্য। কোনো মানুষ যদি তার ঈমানকে শিরক মুক্ত না করতে পারে তাহলে আল্লাহর আজাব থেকে সে রক্ষা পাবে না।

শিরক তিন প্রকার : এক. আল্লাহর সত্তার সাথে শিরক করা। অর্থাৎ আল্লাহকে এক না মেনে একাধিক ইলাহ মানা বা কাউকে আল্লাহর সহযোগী মনে করা। অথবা আল্লাহর স্ত্রী সন্তান আছে বা আল্লাহ কারো থেকে জন্ম নিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা ইত্যাদি। এমন বিশ্বাস যদি কেউ করে তাহলে সে মুশরিক ও কাফের হয়ে যাবে। দুই. আল্লাহর গুণাবলির সাথে শিরক করা। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার বিশেষ এমন কিছু গুণ রয়েছে যেগুলো অন্য কারো নেই। কোনো পীর, ওলি, গাউস কুতুব বা অন্য কারো নেই। এমনকি কোনো নবী-রাসুলেরও ওই গুণ নেই। যেমন- ‘আলিমুল গাইব’ এবং ‘হাজির নাজির’। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা গায়েব বা অদৃশ্যের সবকিছু জানেন এবং একই সময়ে সব জায়গায় আল্লাহতায়ালা উপস্থিত ও সবকিছু দেখেন। এই দুটি গুণ একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। অন্য কেউ এই গুণে গুণান্বিত হতে পারে না। এমনকি আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এই গুণে গুণান্বিত নন। এখন যদি কেউ কোনো পীর বা অলি অথবা কোনো নবীকে এমনকি আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘আলিমুল গাইব’ বা ‘হাজির নাজির’ মনে করে, তাহলে সে মুশরিক হয়ে যাবে। তাই আল্লাহকে ছাড়া অন্য কারো ব্যাপারে এমন ধারণা করা যাবে না। তিন. আল্লাহর ইবাদতের সাথে শিরক করা। অর্থাৎ ইবাদত একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্যই করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্যই ইবাদত করা যাবে না। যেমন নামাজ পড়া, নামাজের রুকু করা, সেজদা করা, রোজা রাখা, হজ করা, মান্নত করা ইত্যাদি। এসব ইবাদত একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্যই করতে হবে। এখন যদি কেউ কোনো মাজারে গিয়ে সেজদা করে অথবা বাবার নামে বা পীরের নামে মান্নত করে তাহলে এটা শিরক হবে। এমনকি আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা শরিফেও যদি কোনো ব্যক্তি সেজদা করে অথবা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে মান্নত করে তাহলেও স্পষ্ট শিরক হবে। তাই ইবাদত একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্য করতে হবে। প্রথম প্রকারের শিরক সাধারণত কোনো মুসলমান করে না। কিন্তু বাকি দুই প্রকার শিরকে অনেক মুসলমানই লিপ্ত। তাই সবাইকেই ঈমানের হেফাজতের জন্য সতর্ক থাকতে হবে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘পিতামাতার অবাধ্য হয়ো না। যদিও তারা ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিতে বলেন।’ অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই পিতামাতার অবাধ্য হওয়া যাবে না। তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা যাবে না। তারা কষ্ট পায় এমন কোনো ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি তাদের সামনে ‘ওফ’ শব্দটাও বলা যাবে না। কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা পিতামাতার সামনে ওফ শব্দটাও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ে কথা বলো না।’ হাদিসে পাকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘পিতামাতার সন্তুষ্টির মাঝে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত আর তাদের অসন্তুষ্টির মাঝে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত’ (তিরমিজি শরিফ)। তাই পিতামাতা নারাজ হন এমন কোনো কাজ করা যাবে না। আল্লাহতায়ালার হকের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হক হলো পিতামাতার হক। কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা যত

জায়গায় নিজের হকের কথা বলেছেন, সাথে সাথে পিতামাতার হকের কথা বলেছেন। তাই প্রতিটি মুসলমানের জন্য আল্লাহর হকের সাথে পিতামাতার হকও আদায় করা আবশ্যক।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ো না। কেননা যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দেয় সে আল্লাহর দায়িত্ব থেকে বের হয়ে যায়।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দিবে, আল্লাহর রহমত তার ওপর থাকবে না। আর যদি কোনো মানুষের ওপর আল্লাহর রহমত না থাকে তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছুই হতে পারে না। ঈমান আনার পর একজন মুমিনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো নামাজ পড়া। ইসলামের মূল পাঁচ ভিত্তির প্রথমটি হলো ঈমান, তার পরের স্থানই হলো নামাজ। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিস শরিফে ইরশাদ করেন, ‘নামাজ হলো দ্বীনের ভিত্তি। যে ব্যক্তি নামাজের হেফাজত করল সে তার দ্বীনের হেফাজত করল। আর যে ব্যক্তি নামাজকে বাদ দিল সে তার দ্বীনকে ধ্বংস করল।’ অন্য এক হাদিসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘নামাজ ঈমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্য’ (তিরমিজি শরিফ)। অর্থাৎ মুমিন নামাজ পড়ে আর কাফের নামাজ পড়ে না। মুসলমানের জন্য নামাজ আবশ্যক। কোনো অবস্থাতেই বিনাকারণে নামাজ ছাড়া যাবে না।

হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কখনো মদ পান করো না। কেননা এটা হলো সমস্ত গুনাহ ও অশ্লীলতার মূল কেন্দ্র।’ মদ পান করা সম্পূর্ণভাবে হারাম। হাদিসে পাকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, ‘মদ পানকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ অন্য এক হাদিসে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মদ পান করবে চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামাজ ও দোয়া কবুল হবে না’ (মেশকাত শরিফ)। এই মদ পান করার কারণে সমাজে অনেক অরাজকতা, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা হয়ে থাকে। বিশেষ করে যুবসমাজ এই মদ ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের কারণে দিন দিন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাই আমাদের সবাইকে মদ ও সকল নেশাজাতীয় দ্রব্য থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আশপাশের সবাইকে এগুলো থেকে বিরত রাখতে হবে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা গুনাহ আল্লাহর রাগ তাড়িয়ে নিয়ে আসে।’ অর্থাৎ গুনাহগার বান্দার ওপর আল্লাহতায়ালা অনেক রাগ করেন। আর যার ওপর আল্লাহতায়ালা রাগ করবেন তার দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘যখন কোনো বান্দা একটি গুনাহ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। যদি সে তওবা করে ফেলে তাহলে সেই কালো দাগ মুছে যায়। আর যদি তওবা না করে আরেকটা গুনাহ করে, তাহলে আরো একটা কালো দাগ তার অন্তরে পড়ে যায়। এভাবে তওবা না করার কারণে তার অন্তরে কালো দাগ পড়তে পড়তে পুরো অন্তরটা একেবারে কুচকুচে কালো হয়ে যায়’ (মেশকাত শরিফ)। বান্দার যখন এই অবস্থা হয় তখন নেক কাজ করতে তার ভালো লাগে না। সওয়াবের কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। শুধু গুনাহের দিকে মন ধাবিত হয়। গুনাহ করলে কোনো খারাপ লাগে না। শয়তান তাকে দিন দিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সে আল্লাহর রহমত থেকে অনেক দূরে চলে যায়। তবে সে যদি খালেছ দিলে তওবা করে, আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, রুনাজারি করে, ভবিষ্যতে আর গুনাহ না করার অঙ্গীকার করে, সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে রহমতের চাদরে ঢেকে নেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন।

মানুষ মাত্রই ভুল। কিন্তু ভুলের ওপর স্থির থাকা শয়তানের সিফাত। তাই যখনই কোনো গুনাহ হয়ে যাবে, সাথে সাথে খাঁটি মনে আল্লাহর কাছে তওবা করে নেওয়া উচিত। এর দ্বারা আল্লাহতায়ালা অনেক খুশি হন। তাই আসুন, আমরা সবাই বেশি বেশি তওবা করার অভ্যাস করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বেশি বেশি নেক আমল করার এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার তৌফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : পরিচালক

জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী, বাংলাদেশ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads