• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

আল্লাহতায়ালার একত্ববাদের পরিচয়

  • প্রকাশিত ২৩ নভেম্বর ২০২০

মুহাম্মদ ইমাম হাসান

 

 

 

আমরা মুসলমান। আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছি। মুসলমান হওয়ার জন্য প্রথম শর্তই হলো ঈমান। আল্লাহ এক, তাঁর কোনোই অংশীদার নেই। আর হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। তাওহিদ মানে আল্লাহর একত্ববাদ। এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও মুখে স্বীকার করা এবং আল্লাহকেই একমাত্র মাবুদ হিসেবে মেনে নেওয়া প্রত্যেকের জন্য ফরজ। আর আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহিদ দ্বারা কী উদ্দেশ্য, কোরআন-হাদিসের আলোকে এর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। তাওহিদ তিন প্রকার। (১) তাওহিদে রুবুবিয়্যাহ। (২) তাওহিদে উলুহিয়্যাহ। (৩) তাওহিদে আসমা ওয়াস সিফাত।

তাওহিদে রুবুবিয়্যাহ : তাওহিদে রুবুবিয়্যাহ হলো প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহকে একক গণ্য করা। যেমন : আল্লাহতায়ালা সব সৃষ্টির পালনকর্তা, সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, জীবন ও মৃত্যুদাতা, কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক। অতএব সব বিপদাপদে তাঁর কাছেই প্রার্থনা করতে হবে। তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক। যেমন মহান আল্লাহ বলেন”‘সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক।’ (সুরা ফাতেহা, আয়াত-১)। মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন, ‘বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের নিকট।’ (সুরা আন-নাস, আয়াত-১)। আল্লাহতায়ালা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। বিশ্বজাহানের সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন তিনি। আল্লাহপাক বলেন “‘তারা কি স্রষ্টা ব্যতীতই সৃষ্ট হয়েছে, না তারা নিজেরাই (নিজেদের) স্রষ্টা।’ (সুরা তুর, আয়াত-৩৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন“‘তুমি যদি তাদেরকে (মুশরিকদেরকে) জিজ্ঞেস কর, কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, এগুলো তো সৃষ্টি করেছেন পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহ।’ (সুরা যুখরুফ, আয়াত-৯)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন “‘তিনি আকাশমণ্ডলী নির্মাণ করেছেন স্তম্ভ ব্যতীত, তোমরা এটা দেখেছ। তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা যাতে এটা তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে এবং এতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বপ্রকার জীব-জন্তু এবং আমরাই আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করে এতে উদ্গত করি সর্বপ্রকার কল্যাণকর উদ্ভিদরাজি। এটা আল্লাহর সৃষ্টি! তিনি ছাড়া অন্যেরা কী সৃষ্টি করেছে তা আমাকে দেখাও; বরং সীমালংঘনকারীরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।’ (সুরা লোকমান, আয়াত-১০, ১১)। মহান আল্লাহই গোটা সৃষ্টির রিযিকদাতা। তিনিই বিশ্বের সব প্রাণীকে রিযিক দান করেন। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘আর ভূপৃষ্ঠে যত প্রাণী বিচরণ করে তাদের সবারই রিযিক আল্লাহ দিয়ে থাকেন।’ (সুরা হুদ, আয়াত-৬)। আল্লাহই মাসুষের জীবনদাতা ও মৃত্যুদাতা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কীরূপে তোমরা আল্লাহকে অবিশ্বাস করছ? অথচ তোমরা নির্জীব ছিলে, পরে তিনিই তোমাদেরকে জীবিত করেছেন, পুনরায় তিনি তোমাদেরকে নির্জীব করবেন, পরে আবার জীবন্ত করবেন। অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৮)।

উপরে বর্ণিত বিষয়সমূহে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা যাবে না। কারণ আমরা সবাই রূহের জগতে মহান আল্লাহকে প্রতিপালক হিসেবে স্বীকৃতি দান করেছি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! যখন তোমার প্রতিপালক বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের সন্তানদেরকে বের করলেন এবং তাদেরকেই তাদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, হ্যাঁ! আমরা সাক্ষী থাকলাম। (এই স্বীকৃতি এজন্য যে), যাতে তোমরা কিয়ামতের দিন বলতে না পার আমরা এবিষয়ে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলাম।’ (সুরা আরাফ, আয়াত-১৭২)।

প্রত্যেক আদম সন্তানই ইসলামের ওপর তথা তাওহিদের ওপর জন্ম লাভ করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘প্রত্যেক নবজাতকই ফিৎরাতের ওপর (তাওহিদের ওপর) জন্মলাভ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, নাসারা বা অগ্নিপূজকরূপে গড়ে তোলে। যেমন চতুষ্পদ প্রাণী একটা পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে কোনো (জন্মগত) কানকাটা দেখতে পাও? অতঃপর আবু হুরায়রা (রা.) কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করলেন, তাঁর (আল্লাহর) দেওয়া ফিৎরাতের অনুসরণ করো, যে ফিৎরাতের ওপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই, এটাই সরল সুদৃঢ় দিন।’ (সুরা রুম, আয়াত-৩০)। অতএব যে ফিৎরাতের ওপর মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তার ওপর অটল থাকলে সে সরল-সঠিক সুদৃঢ় পথে টিকে থাকবে। এতে তার ঈমান বাড়বে এবং পরকালে সুখময় স্থান জান্নাত লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। পক্ষান্তরে ফিৎরাতের পরিবর্তন করলেই সঠিক পথ হারিয়ে বিভ্রান্ত হবে।

তাওহিদে উলুহিয়্যাহ বা তাওহিদে ইবাদত : সব প্রকার ইবাদতে আল্লাহকে একক গণ্য করা। যেমন সালাত, সিয়াম, হজ্ব, যাকাত, যবেহ-কুরবানি, নযর-নিয়াজ, রুকূ-সিজদা, ভয়-ভীতি, আশা-ভরসা ইত্যাদি সবকিছু আল্লাহর জন্যই হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমরা শুধুমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।’ (সুরা ফাতেহা, আয়াত-৪)। অতএব আমরা আমাদের প্রকৃত মাবুদের কাছেই সব বিপদ-আপদ থেকে আশ্রয় চাইব। একমাত্র তাঁরই ইবাদত করব। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসুল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাগুত হতে নিরাপদ থাকবে।’ (সুরা নাহল, আয়াত -৩৬)। অতএব শুধু আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে, কোনো অবস্থাতেই অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তোমার পূর্বে কোনো রাসুল প্রেরণ করিনি এই অহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া অন্য কোনো (হক্ব) মাবুদ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-২৫)। তিনি আরো বলেন, ‘নুহকে তাঁর কওমের নিকট পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার কওম! তোমরা শুধু আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো সত্য মাবুদ নেই।’ (সুরা আরাফ, আয়াত-৫৯)।

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা আল্লাহরই ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৩৬)। আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা যারিয়াত, আয়াত-৫৬)।

অতএব বোঝা যাচ্ছে, মহান আল্লাহ জিন ও মানুষকে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। ইবাদতের মধ্যে শিরকমিশ্রিত হলে ইবাদত বাতিল হয়ে যায়। যেমন পবিত্রতার মধ্যে অপবিত্র মিশ্রিত হলে সেটি বাতিল বলে গণ্য হয়। আর শিরককারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয়ে যায়। এজন্য শিরক থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে অংশীস্থাপনকারীকে ক্ষমা করবেন না, তবে এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১১৬)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে (অন্য কাউকে) শরিক করবে, আল্লাহ তাঁর জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (সুরা মায়েদাহ, আয়াত-৭২)। অতএব শুধু আল্লাহর উদ্দেশেই ইবাদত করা ঈমানের দাবি। পক্ষান্তরে শিরকমিশ্রিত ইবাদত করলে ঈমানে ঘাটতি পড়বে।

তাওহিদে আসমা ওয়াস সিফাত :  কোরআন ও হাদিসে আল্লাহর নাম ও সিফাত (গুণাবলি) সমূহ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করা এবং সেগুলোর প্রতি ঈমান আনা হচ্ছে তাওহিদে আসমা ওয়াস সিফাত। কোনো পরিবর্তন-পরিবর্ধন না করে, অস্বীকার না করে, অবস্থা বর্ণনা না করে এবং কারো সাথে সাদৃশ্য প্রদান না করে আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ওপর ঈমান আনতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ রয়েছে। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামে ডাকো, আর তাদেরকে বর্জন করো যারা তাঁর নামসমূহ বিকৃত করে, সত্বরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে।’ (সুরা আরাফ, আয়াত-১৮০)।

আল্লাহর নাম ও গুণাবলি যেভাবে কোরআন ও সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে। কারো সাথে তাঁর সাদৃশ্য করা যাবে না। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা আশশূরা, আয়াত-১১)। আল্লাহতায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পিছনে পড়ো না।’ (সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত-৩৬)। আয়াতটিতে আল্লাহর অবস্থা কেমন তা বর্ণনা করতে নিষেধ করা হয়েছে।  কোরআন এবং সহিহ হাদিসে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করতে বলা হয়েছে। মানবজীবনে তিন প্রকার তাওহিদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঈমান মজবুত হবে ও ইহকাল-পরকাল সুখময় হবে।

আল্লাহতায়ালার নামগুলো যেভাবে  কোরআন ও সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করা, অর্থ বুঝে মুখস্থ করে আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলে ঈমান বাড়বে এবং জান্নাত লাভ করা যাবে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার এক কম একশটি অর্থাৎ নিরানববইটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এগুলো মুখস্থ করবে (অর্থ বুঝে আমল করবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে, যে ব্যক্তি এগুলোর হিফাজত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ বেজোড়। তিনি বেজোড় পছন্দ করেন।’

লেখক : ইমাম ও খতিব

 টুটালিয়াপাড়া জামে মসজিদ, সাভার, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads