• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

গৃহকর্মী নির্যাতন আর নয়

  • প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারি ২০২১

শ্যামলী তানজিন অনু

 

যারা শহরে বাসা-বাড়িতে থাকে তাদের কাজের সহায়তার জন্য প্রায় প্রত্যেকেই নিজ বাড়িতে গৃহকর্মী রাখেন। গ্রামেও রাখেন অনেকে। বাড়িটাকে নিজের বাড়ি মনে করে সব কাজ করে গৃহকর্মীরা। কিন্তু দেখা যায় দেশে বিভিন্ন জায়গায় তাদের নির্যাতনের খবর শোনা যাচ্ছে বা দেখা যাচ্ছে। যারা একটি সংসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সহায়তা করছেন তাদের ওপর কেন এতো নির্যাতন! খেয়াল করলে দেখা যায়, গৃহকর্মীদের মধ্যে প্রায় বেশিরভাগই অল্প বয়সী মেয়ে। মোটামুটি ১২/১৩ বছর থেকে শুরু করে ১৭/১৮ বছরের। যে সময়টাতে তাদের থাকার কথা স্কুলে, সে সময়ে তারা অন্যের বাড়ি কাজ করে পেট চালাচ্ছে। খুব দরিদ্র পরিবারের। অধিক জনসংখ্যা হওয়ায় তাদের নাম হয় গৃহকর্মী। এই যে গৃহকর্মী সম্বোধন করছি এটাও অনেকে করে না। সম্বোধন করা হয় বাড়ির কাজের লোক বলে।

ঘর ঝাড়ু থেকে চন্ডিপাঠ সবই তাদের করতে হয়। একরকম বাধ্য হয় করতে। মাস শেষে সম্মানি তো আর মুখ দেখে দেয় না। শহরে যারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকুরিজীবী তারা সকালে বের হয় ফেরে হয়তো রাতে বা সন্ধ্যায়। এর মাঝে সংসারের যাবতীয় কাজ করা, গৃহকর্তার সন্তানের দেখাশোনা করা, সবই করতে হয়। মানুষের ম্যাচিউরিটি বয়সে আসে না, আসে পরিস্থিতির স্বীকার হলে। কিশোরী গৃহকর্মীরা দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে ছোটবেলা থেকেই সব কাজ শিখে যায়। তারা জানে কীভাবে একটা সংসারের সব কাজ করতে হয়। তবে স্বাভাবিকভাবেই কোনো কাজে ভুল হতে পারে। তার মানে এটা না তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করতে হবে। দেশের প্রায় সব জায়গা গৃহকর্মী নির্যাতনের কথা শোনা যায়। দিনের পর দিন চলে সেসব নিষ্ঠুর নির্যাতন। ভয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতে হয়। কিন্তু আর কতো? শুধু মেয়েরাই না, এ কাজে অল্প বয়সী অনেক ছেলেদেরও দেখা যায় ইদানিং। অনেক আগে থেকেই চলছে   গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন। অনেকে গৃহকর্মীদের মানুষ মনে করে না। অসুস্থ হলে দেখার কেউ  নেই, ঠিকমতো তাদের প্রয়োজনীয় খাবার, থাকার জায়গা দেওয়া হয়না। বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে এদের নিয়ে লেখালেখি হয়। সংগঠন থেকে নানাভাবে সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়ার পরেও কোনো লাভ হয়না। নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশে ২০ থেকে ২৫ লাখ গৃহকর্মী অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। অথচ এদের নিয়ে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।

সপ্তাহখানিক আগের ঘটনা। সিরাজগঞ্জে কলেজ শিক্ষিকার অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নাবালক কিশোরী নিখোঁজ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে নিজের মুখে বলছে মাঝে মাঝেই তাকে লাঠি, জুতা, ঝাঁটা, শলা দিয়ে খুব নির্যাতন করত। কাজে ভুল হলেই মাইর দিত। এরই ফলে মেয়েটি ভয়ে পালিয়ে যায়।

শেরপুরের শ্রীবরদীতে নির্যাতনের শিকার শিশু গৃহকর্মী সাদিয়া পারভিন (১০) মারা যায়। প্রায় একমাস চিকিৎসাধীন থাকার পর (২৩ অক্টোবর) ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। শুধু সিরাজগঞ্জ বা শেরপুর নয়। দেশজুড়ে চলছে গৃহকর্মী নির্যাতন। কিন্তু এর শেষ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। গৃহকর্মী নির্যাতনই শেষ কথা নয়। অপহরণ, ধর্ষণ, খুন, গুমের খবরও সর্বত্র পাওয়া যায়।

নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ কঠোরভাবে দমনের জন্য সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করে। ২০০০ সালে আইনটি প্রণয়নের পর ২০০৩ সালে এটি সংশোধিত হয়। এর আওতায় কিছু আইন প্রণয়ন হয়। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে অপহরণ করেন, তা হলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা চৌদ্দ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। যদি কোনো ব্যক্তি মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশে কোনো নারী বা শিশুকে আটক করেন, তাহলে ওই ব্যক্তিও মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন ও অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।

আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো দাস-দাসি তোমাদের জন্য খাবার তৈরি করে এনে দেয় তখন নিজের সঙ্গে বসিয়ে তাকে খাওয়াবে। কেননা, সে ধোঁয়া ও তাপ সহ্য করেছে। আর কোনো খাবার যদি পরিমাণে কম হয় তবে অন্তত দু-একমুঠো তার হাতে দেবে। (সহিহ মুসলিম) সহিহ বুখারি শরিফের বর্ণনা মতে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু মুহূর্তে শেষ বাক্য হিসেবে বলে গেছেন- ‘নামাজ আর দাস-দাসিদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে। কথাগুলো নবীজি বারবার বলেছেন’।

হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী বুঝা যায়, ‌গৃহকর্মীরা পরিবারের সদস্যতুল্য। পরিবারের অন্য সদস্য যা খাবে, গৃহকর্মীও তাই খাবে। অপারগ হয় এমন কোনো কাজ তাদের দেওয়া যাবেনা। প্রয়োজনে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে হবে। নিজ সন্তানের মতো তাদের যত্ন নিতে হবে। পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে। গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় সরকার একটি নীতিমালা করে দিয়েছে। আর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ১৬ জুনকে ‘আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালনও করা হচ্ছে। প্রতি বছর মে দিবস এলে গৃহকর্মীসহ সব শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠে পুরো জাতি। কিন্তু নির্যাতন কমছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় সরকার নীতিমালা করে দিলেও তা বাস্তবায়নে তেমন কোনো আগ্রহ কারো মধ্যে নেই। এটা কারো একার কাজ না, সকলের উচিত গৃহকর্মীদের প্রতি সদয় হওয়া। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। তাদেরকে নির্যাতন না করে ভালোবাসুন। তারাও মানুষ।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

Shamolzkhatun333¦@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads