• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
আইয়ুব বাচ্চু কিন্তু লাকি!

আইয়ুব বাচ্চু

সংগৃহীত ছবি

শোবিজ

আইয়ুব বাচ্চু কিন্তু লাকি!

  • আসিফ উল আলম সোহান
  • প্রকাশিত ০১ নভেম্বর ২০১৮

১৯৯১-৯২ সাল। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। স্বপ্ন গিটার শিখব, ব্যান্ড করব। গিটারের অনুপ্রেরণা বাংলাদেশে যে দুজন ছিলেন তাদের মধ্যে ক্লাসিক্যালে নীলয় দা আর বাচ্চু ভাই, আইয়ুব বাচ্চু। জন্মদিনে ফুফার দেওয়া টাকার সঙ্গে আব্বুর দেওয়া টাকা মিলিয়ে গিবসন একটা উডেন গিটার কিনলাম। সেই সময়কার খুব পরিচিত ও বহুল বিক্রীত গিটারের ব্র্যান্ড ছিল গিবসন। আগে থেকেই টুক টাক কিছুটা বাজাতে পারতাম। এবার ভর্তি হলাম ধানমন্ডির ফেলিসিতাসিওন স্কুলে। চলতে থাকল গিটারের করডিং ও আরপিজিও শেখা। এদিকে বন্ধুরা মিলে একটা ব্যান্ড করেছি, চলছে প্র্যাকটিস আর প্রথম অডিও ক্যাসেট রেকর্ডিংয়ের কাজ। আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের হাসতে দেখ গাইতে দেখ, কষ্ট পেতে ভালোবাসি— এমন কালজয়ী সব গানের রচয়িতা লতিফুল ইসলাম শিবলি ভাই লিখছেন আমাদের জন্য গান। আমি ভোকাল ও লিড গিটার বাজাতাম। বাচ্চু ভাই সেসময় লিটল রিভার ব্যান্ড (এলআরবি) নামে নতুন ব্যান্ড করেছে। বাচ্চু ভাইয়ের গিটার বাজানো দেখতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। বাচ্চু ভাই একটা গিটার বাজাতেন ফেইন্ডার গিটার। ও রকম একটা সাদা রঙের ফেইন্ডার গিটার আমার হবে, এটি ছিল আমার একটা স্বপ্ন। কিছুদিন পর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। মেলোডি অ্যান্ড কোং-এর সম্রাট দা’কে টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে আনালাম বাচ্চু ভাইয়ের মতো আমার সেই স্বপ্নের গিটার।

এর অনেক পরের কথা। ২০০১ সাল সবেমাত্র জার্নালিজম পড়া শেষ করে সৈয়দ বোরহান কবিরের সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিভিশনের পরিপ্রেক্ষিত অনুষ্ঠানের শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। বোরহান কবিরের অফিস তখন সিদ্ধেশ্বরীর ইমপ্রেস টেলিফিল্মের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে। ফরিদুর রেজা সাগর ভাইয়ের ইমপ্রেস টেলিফিল্ম থেকেই ক্যামেরা এডিটিংসহ সকল কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে পরিপ্রেক্ষিত আনুষ্ঠান নির্মাণ করে বিটিভিতে জমা দেওয়া হতো। ওই ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকেই চ্যানেল আইয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে এবং চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ভাইয়ের অফিস কক্ষটিও ছিল ওই ফ্লোরেই। সাগর ভাইয়ের আফিস কক্ষের ঠিক পাশে ডানের রুমটাই ছিল ১ নম্বর লিনিয়ার এডিটিং প্যানেল। এই প্যানেলটিকে তখন চ্যানেল আইয়ের প্রাণ মনে করা হতো। আমরা পরিপ্রেক্ষিত অনুষ্ঠানের এডিটিং এখানেই করতাম যার ফলে আসতে যেতে সব সময় সাগর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া কথা, বলা ছিল নিয়মিত একটি বিষয়।

একদিন সাগর ভাইকে বললাম একটা অনুষ্ঠান করি সেলিব্রিটি বায়োগ্রাফিক্যাল টকশো করব। যেখানে আমাদের দেশের স্ব স্ব ক্ষেত্রে নামকরা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আমন্ত্রিত অতিথির সাক্ষাৎকারসহ তার কর্মজীবনের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো তুলে ধরব। সাগর ভাই যেন অপেক্ষায় ছিলেন আমার প্রপোজালের, সঙ্গে সঙ্গে বললেন অনুষ্ঠান বানিয়ে ক্যাসেট নিয়ে চলে এসো।

যেহেতু গান বাজনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম, ব্যান্ড করতাম, প্রথমেই মাথায় এলো আইয়ুব বাচ্চু ভাইকে নিয়ে প্রথম পর্বটা শুরু করব। চ্যানেল আইয়ের এক ম্যানেজার (এখন তিনি জিএম) হেলাল ভাই বললেন— বাচ্চু ভাই খুব লাকি। তাকে দিয়ে কোনো কিছু শুরু করলে সেটা ভালো হয়। আমাদের লোগো থিম মিউজিক সব বাচ্চু ভাই করেছে।

চ্যানেল আই থেকে বাচ্চু ভাইয়ের নম্বর নিয়ে টেলিফোন করে পুরো অনুষ্ঠানের আইডিয়াটা নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো। তারপর উনার মগবাজারের ফ্ল্যাটে দেখা করে কথা হলো। আমি বললাম তাকে পুরোটা অনুষ্ঠানই  হবে আপনাকে নিয়ে, আপনার সঙ্গে গল্প করব বিভিন্ন ঘটনা আমাদের বলবেন, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে আপনার গানের একটা মিউজিক ভিডিও আমি বানাব সেটাও দেখাব। আর সবশেষে আপনি আপনার ব্যবহার করা যেকোনো একটি জিনিস দর্শকদের জন্য উপহার দিয়ে যাবেন এবং একটি অটোগ্রাফ দেবেন। আমরা দর্শকদের একটা প্রশ্ন করব আপানকে নিয়ে। দর্শকরা আমাদের কাছে চিঠি লিখবে এক কপি ছবিসহ উত্তর লিখে। যিনি সঠিক উত্তর দেবেন লটারি করে বিজয়ী ব্যক্তির ছবি ও নাম পরের পর্বে ঘোষণা করে আপনার দেওয়া গিফট আর অটোগ্রাফ তার ঠিকানায় পৌঁছে দেব। বাচ্চু ভাই শুনে খুশি হলেন। বললেন, বাহ দারুণ আইডিয়া তো। আমি চিটাগাংয়ের বামবার কনসার্টে একটি গোল হ্যাট পরে পারফর্ম করেছি, বিটিভিতেও পরেছি এ রকম একটি ক্যাপ। এটা উপহার দেব। শুনে তো আমি মহাখুশি, আকাশে উড়ছি। তখনই আবদুর নুর তুষার ভাইকে বললাম আপনার বেটাক্যাম আমি এক শিফটের জন্য ভাড়া নেব। তুষার ভাই তখন শুভেচ্ছা করে দারুণ ফেমাস। তুষার ভাই বলল সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাড়া ৩ হাজার টাকা। ক্যামেরাম্যান কিন্তু তোমার ঠিক করতে হবে। সাগর ভাইয়ের শ্যালক জুবাইয়েদ হোসেন তুফান ভাই চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরা পারসন। স্পেশাল প্রোগ্রামগুলো তিনি করেন। আমি ক্যামেরামান খুঁজছি শুনে বললেন আসিফ ভাই কোনো চিন্তা করেন না। আমি আপনার সুটিং করে দেব। ক্যাসেট কিনলাম, গাড়ি ভাড়া করলাম। ক্রুসহ দশজনের একটা টিম রেডি করলাম। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে থাকল মোহাম্মদ আলি বাবু।

হেলাল ভাইকে (হেলাল খান) বললাম পুরো ইউনিট নিয়ে দুপুরে বের হব, মগবাজারে শুটিং। যেহেত বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আগেই কনফার্ম করা ছিল তাই আর পরের দিন টেলিফোন না করে ইউনিট চ্যানেল আই থেকে তুলে ৫টায় সোজা চলে গেলাম বাচ্চু ভাইয়ের এবি কিচেন। সঙ্গে নিলাম বাচ্চু ভাইয়ের পছন্দের দুটো ইউডি কোলন ওয়াইএসএলের কোরাস এবং গিভেন্সির জ্যান্টলম্যান। বাচ্চু ভাইকে কি টাকা পয়সা দেব? তার চেয়ে খুঁজে খুঁজে বাচ্চু ভাইয়ের পছন্দের দুটো পারফিউম কিনেছিলাম। পুরো ইউনিট নিয়ে যখন বাচ্চু ভাইয়ের এবি কিচেনে গেলাম তখন বিকাল ৫টা ১৫ মিনিট। কী আশ্চর্য! এবি কিচেন তালা দেয়া! কেউই নেই ওখানে। তুফান ভাই (জুবায়েদ হোসেন তুফান) ক্যামেরা পারসন বলল— টেলিফোন করে আজকে কনফার্ম করেন নেই? বললাম— ভাই কনফার্ম তো করাই ছিল, নতুন করে আবার কি কনফার্ম করব? বাচ্চু ভাইয়ের এর মোবাইলে টেলিফোন করলাম মোবাইল বন্ধ, কি করি এখন পুরো ইউনিট গাড়িতে বসা। বাচ্চু ভাইয়ের বাসায় এলাম, তিনি বাসায়ও নেই। টানা টেলিফোন করে চলছি মোবাইল বন্ধ। এসএমএস করে রাখলাম। বসে থাকতে থাকতে ৮টা ৯টা ১০টা পার হয়ে ১১টা বেজে গেল বাচ্চু ভাই আসারও খবর নেই মোবাইলও বন্ধ। বাসা আর এবি কিচেন কাছাকা‌ছি হওয়ায় অপেক্ষার এই সময়ে ইউনিট গাড়িতে বসিয়ে রেখে হেঁটে হেঁটে ৬-৭ বার বাসায় খোঁজ করলাম, কেউই বলতে পারল না তিনি কোথায়। এদিকে সবাই অপেক্ষা করে বিরক্ত। তুফান ভাই বললেন আসিফ ভাই, বাচ্চু ভাই এ রকম করে। চলেন হাউজে ফিরে যাই। টেলিফোনে কথা বলে আবার শিফট নিয়েন। মাথাটা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। ২০-২৫ হাজার টাকা গচ্চা, গাড়ি ভাড়া, বেটাক্যাম ভাড়া, লাইটয়ের বিল, ক্যামেরাম্যানের টাকা, ক্রুদের শিফটের টাকা শোধ করে আমার তো সব শেষ হয়ে যাবে। আমার এমন অবস্থা দেখে তুফান ভাই বললেন— চিন্তা করতে হবে না আসিফ ভাই। কি করব চ্যানেল আইয়ে ফিরে গেলাম ইউনিট নিয়ে। হেলাল ভাই (চ্যানেল আই এর জিএম) বললেন— বাচ্চু ভাই এ রকম একটু করেন। যাক টেলিফোন করেন আমি ক্যামেরা আরেক দিন বুকিং রাখব।

এদিকে আমি একটার পর একটা কল করছি মোবাইলে বাচ্চু ভাইয়ের ফোন বন্ধ। একাধারসে মোবাইলে চেষ্টা করতে করতে আমার তখনকার সিমেন্স ফোনের ব্যাটারি শেষের দিকে কিন্তু বাচ্চু ভাইয়ের মোবাইল খুলছে না। খুব রাগ লাগছে এত বড় মাপের একজন মানুষ আমার মতো একটা নতুন মিডিয়ায় কাজ করতে আসা ছেলেকে এ রকম ভোগাচ্ছেন! এরা কেন এমন হয়? এ রকম ভাবছি আর মোবাইলে চেষ্টা করছি হঠাৎ দেখি মোবাইলে রিং হচ্ছে, ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা বাজে। রিং বাজছে কিন্তু ফোন ধরছে না। এরপর এক সময় ভারী গলায় ফোন ধরলেন, বললাম বাচ্চু ভাই আমি আসিফ। ‘ওহো ভাইয়া আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম।’ আমি এখন কি করব ভাই জিঙ্গেস করায় বলল— তোমার কতক্ষণ সময় লাগবে আসিফ? বললাম, আপনার সাক্ষাৎকার করব আধাঘণ্টার একটা প্রোগ্রাম শুধু আপনাকে নিয়েই। বললেন ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। একটা কাজ করো ভাইয়া আর টেলিফোন করতে হবে না তুমি কাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে সোজা আমার স্টুডিওতে চলে এসো। সালাম দিয়ে মোবাইল কেটে সঙ্গে সঙ্গে এতরাতেই আবার হেলাল ভাইকে টেলিফোন করলাম যদি পরে ক্যামেরা ভাড়া না পাই।

হেলাল ভাই বললেন— সব রেডি থাকবে অসুবিধা নেই। বাচ্চু ভাই একটু কষ্ট দেয় তবে তাকে খুব লাকি বলে মনে করি আমরা সবাই। বাচ্চু ভাইকে দিয়ে যখন শুরু করছেন ভালো কিছুই হবে।

 

[চলবে...]

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads