কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন, চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়-বিচ্ছেদ নয়, চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্নকরা আর্দ্র রজনী, চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে, আমার না-থাকা জুড়ে।’
এই চলে যাওয়ার কথা হয়তো অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। আর তাই ফেসবুকের শেষ স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও... তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।’ হয়তো মনে ছিল তার হাজারো ক্ষোভ, অভিমান, না পাওয়ার বেদনা আর ভাই হারানোর ক্রন্দন। তিনি হয়তো তখনো জানতেন না, কোটি মানুষের হূদয়ে গেঁথে রইবে তার নামটি-‘আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল’। ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
নামটির সাথে মিশে আছে কথা, সুর, দেশ, মুক্তি, ভালোবাসা আর বুক ভরা ক্রন্দন। আমাদের সংগীত জগতে কথা ও সুরের ঐশ্বর্যে প্রতিভাবান এক সংগীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালকসহ অনেক গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিটি মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। তার এই চলে যাওয়া সংগীতজগতে তাই শুধু ক্ষতের সৃষ্টিই করেনি, তৈরি করেছে এক বিশাল শূন্যস্থান, যা সত্যিই অপূরণীয়।
১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার আজিমপুরে জন্ম এই প্রবাদপুরুষের। খুব দুরন্তপনায় কাটছিল বুলবুলের শৈশব। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি খুব আগ্রহ দেখা যায় তার। বাবার সাথে বাড়িতে বসে রেডিও শোনা ছিল নিত্যদিনের দিনলিপি। গান শুনতে শুনতে গান গাওয়ার চেষ্টাও শুরু হলো। গিটার কেনার মাধ্যমে প্রথম বাদ্যযন্ত্র হাতে তুলে নিলেন। প্রকৃতিই যেন তার সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুরু। নিজে নিজেই শিখে ফেলেছিলেন গিটার, পিয়ানো ও হারমোনিয়াম। মাত্র তেরো বছর বয়সেই তৈরি করেছিলেন জীবনের প্রথম গান, ‘ও মন ময়না, আয় ফিরে আয় না।’ কিন্তু হাসিখুশিমাখা শৈশবের দিনগুলো খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি বুলবুলের। এলো ১৯৭১ সাল, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মাধ্যমিক পড়ুয়া আহমেদ ইমতিয়াজের বয়স ছিল তখন মাত্র পনেরো বছর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বড় ভাই টুলটুল যুদ্ধে যোগদান করেন। তখন থেকেই তিনি যেন নিজেকে আর ঘরে বেঁধে রাখতে পারছিলেন না। দেশ মাকে রক্ষা করার জন্য মায়ের অনুমতি নিয়ে বন্ধু মানিক ও মাহবুবকে নিয়ে চলে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানি বাঙ্কার খোঁজার উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে জুলাই মাসে বন্ধু সরোয়ারকে নিয়ে ঢাকার নিউমার্কেটের প্রবেশমুখে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িতে গ্রেনেড হামলা করেন। পরের মাসেই তিনি চলে যান ভারতের আগরতলায় প্রশিক্ষণের জন্য। সেখান থেকে ফিরে এসে ঢাকায় ফিরে ‘ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন’ নামে গেরিলা দল গঠন করে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি মেজর আবু মুহম্মদ হায়দারের অধীনে ২নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন।
অক্টোবরের দিকে পুনরায় ভারত যাওয়ার সময় আরো তিনজন সহযোদ্ধাসহ কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি চেকপোস্টে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন। সেখানে তাদের বন্দি করে রাখা হয়। তার চোখের সামনে তেতাল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধাকে একত্রে গুলি করে মেরে ফেলে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী। পরবর্তীতে তাকে ঢাকার রমনা থানায় স্থানান্তরিত করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন না করে ফিরে আসেন বুলবুল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর একটি দল তাকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুনরায় সংগীত নিয়ে মেতে ওঠেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ‘আফটার মেথ’ নামে একটি গানের দল তৈরি করেন। ১৯৭৬ সালে বিটিভির জন্যে গান করার সৌভাগ্য হয় তার। মুক্তিযুদ্ধের সকল অভিজ্ঞতা যেন তার লেখা আর সুরে প্রতিফলিত হয় । পরবর্তী সাত বছর ধরে শুধু দেশাত্মবোধক গানই তৈরি করে চলেন তিনি। তারপর শুরু হয় তার চলচ্চিত্রে গান করা। নাগরদোলা ছবির জন্যে ‘ও আমার মন কান্দে’ গানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গনে পদার্পণ হয় তার। ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে প্রথম সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পান আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তবে সকলের সুনজরে পড়েন ‘নয়নের আলো’ সিনেমাটিতে সুর করার মধ্য দিয়ে। ‘নয়নের আলো’ সিনেমাটির সুর করা প্রায় প্রত্যেকটি গানই সেই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। এই চলচ্চিত্রের পর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পরবর্তী সময়ে প্রায় কয়েকশ চলচ্চিত্রে সুর ও সংগীতের কাজ করেছেন তিনি।
চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি অনেক শিল্পীর জন্য ব্যক্তিগত অ্যালবামেও কাজ করেছেন। বাংলাদেশের প্রায় সকল জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী তার সাথে কাজ করেছেন।দেশের সংগীত জগতে অসামান্য কীর্তির জন্যে ২০১০ সালে তিনি একুশে পদক পান।
এছাড়া ২০০১ সালে ‘প্রেমের তাজমহল’ এবং ২০০৫ সালে ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রের সংগীতায়োজনের জন্যে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পাশাপাশি বেশ কয়েকবার সেরা গীতিকারের জন্য ‘বাচসাস’ পুরস্কার পান তিনি। এছাড়া রিয়েলিটি শো ‘ক্লোজ আপ ওয়ানের’ তিন মৌসুমের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো ক্ষণজন্মা মানুষের কখনো মৃত্যু নেই, হতে পারে না। তারা বেঁচে থাকবেন কোটি মানুষের হূদয়ে, কোটি মানুষের কণ্ঠে। প্রকৃত বীর কখনো কোনো ভয়ে ভীত হন না। ২০১২ সালে তাই তিনি আবার নেমে পড়লেন নতুন যুদ্ধে। সেই বছর আগস্ট মাসে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে গঠন করা ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে’ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করতে কাঠগড়ায় দাঁড়ান। হাজার ভয়-ভীতি এবং জীবননাশের হুমকিকে অগ্রাহ্য করে উচ্চারণ করেন তার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা।