• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
শুভ জন্মদিন পপগুরু

সংগৃহীত ছবি

শোবিজ

শুভ জন্মদিন পপগুরু

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশের ‘পপসম্রাট’ উপাধি একজনেরই আছে, তিনি হচ্ছেন আজম খান। পুরো নাম মাহবুবুল হক খান। একজন সাধারণ বাঙালির চেয়ে একটু লম্বা, হ্যাংলা-পাতলা সাধাসিধে জামাকাপড় পরিহিত একজন মানুষ ছিলেন এই পপসম্রাট আজম খান। ‘গুরু’,  ‘রকসম্রাট’, ‘পপসম্রাট’সহ আরো অনেক উপাধি থাকলেও সবাই তাকে ‘আজম খান’ নামেই বেশি চেনে।

আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার আজিমপুর কলোনির ১০নং সরকারি কোয়ার্টারে। তার পিতা আফতাবউদ্দিন খান ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি’-এর বাংলায় স্বর্ণ পদক জয়ী ও একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তার মাতা জোবেদা খাতুন ছিলেন একজন গায়িকা। ১৯৫৫ সালে তিনি প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলের বাণিজ্য শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে সেখান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন এবং তারপর তিনি ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে কমার্স বা বাণিজ্য শিক্ষা বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন।

আজম খান ছোটবেলার থেকেই একজন সংগীতপ্রেমী ছিলেন। ছিলেন একটু বিপ্লবী মনোভাবের। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই তখন দেশে একটা আন্দোলনের ভাব বজায় ছিল। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী তখন আঁচ করতে পারছিল পশ্চিম পাকিস্তান অন্যায়ভাবে শাসনের নামে শোষণ করে যাচ্ছে। আজম খান তৎকালীন সময়ে জোরালো আন্দোলনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন, কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানে শোষণ করত সে বিষয়ে জনসাধারণকে অবগত করার জন্য। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি তখন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসংগীত প্রচার করেন।

তারপরের বছরেই ১৯৭১ সালের দেশে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দেশের এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা টহল দিতে শুরু করে।

আজম খানরা তখন কমলাপুর এলাকাতেই থাকতেন। সেই সময়েও গুরু আজম খান তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এলাকার রাস্তায় ব্যারিকেড দিতেন। আর্মি আসলে দেয়াল টপকিয়ে কমলাপুর কলোনিতে চলে যেতেন, আবার কলোনিতে আর্মি আসলে দেয়াল টপকিয়ে এ পাশে চলে আসতেন। এভাবে করতে করতেই বন্ধুবান্ধবরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন যে এভাবে গুটিয়ে-লুকিয়ে বাঁচা আর নয়, মৃত্যু যখন হবেই, যুদ্ধে গিয়েই তা মাথা পেতে বরণ করে নেবেন।

যুদ্ধে যাবার আগে আজম খান উনার মা জোবেদা খাতুনকে বলেন, ‘আম্মা, এখানে তো আর থাকা যায় না। যুদ্ধে করতে যাইতেসি।’ উনার মা একদম নির্ভয়ে উত্তর দিলেন, ‘যুদ্ধ করতে যাচ্ছিস ভালো কথা। তোর আব্বাকে বলে যা।’

আজম খানের পিতা আফতাবউদ্দিন খান অনেক গম্ভীর মানুষ ছিলেন। যুবক আজম খান বাবার সামনে মাথা কাঁচুমাচু করে বললেন, ‘আব্বা, যুদ্ধে যাচ্ছি।’ আজম খান ধরেই বসেছিলেন তার বাবা এতে রেগে গিয়ে উনাকে চড় মেরে বসবেন। কিন্তু তা না করে পিতা তাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘যুদ্ধে যাবি যা। কিন্তু স্বাধীন না করে ঘরে ফিরবি না।’

পিতার অনুমতি পেয়ে পিতাকে মাথা নিচু করে সালাম করে চলে গেলেন যুদ্ধে। দেশ স্বাধীনের জন্য মাত্র ২১ বছর বয়সেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজম খান কর্নেল খালেদ মোশাররফের অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ঢাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। সেখানে সালদার যুদ্ধে জয়ী হবার পর আজম খানকে দুই নম্বর সেক্টরের একটি গেরিলা গ্রুপের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তাদের ঢাকায় পাঠানো হয় যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, সায়েদাবাদসহ কিছু এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে। গেরিলা অপারেশন ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর অন্যতম একজন সদস্য হচ্ছেন আজম খান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের বিখ্যাত অপারেশন ‘অপারেশন তিতাস’এও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

তার গানের গলা ছিল শক্তিশালী এবং অস্ফুট। তার গাইবার ধরন এমন ছিল যে সে যেকোনো ধরনের লিরিক্সের ভাব বদলে দিতে পারত তার কণ্ঠের জাদু। একটি সাধারণ গান ‘জ্বালা জ্বালা’কে একটা প্রশংসাগীতিতে রূপ দিয়েছিলেন। একটা প্রজন্মের নয়, পুরো একটা সময়ের প্রশংসাগীতি হয়ে গিয়েছিল তার কণ্ঠে গাওয়া গানটি ।

যুদ্ধ শেষ হবার পরে ১৯৭২ সালে তিনি ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ গড়ে তোলেন তার বন্ধুদের নিয়ে। লাইনআপে ছিলেন তিনি নিজে ভোকালিস্ট, গিটারে ছিল মনসুর আর নিলু আর ড্রামসে সাদেক। ১৯৭২ সালে তার গান ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি বিটিভিতে প্রচার হয়ে ব্যাপক সাড়া পায় শ্রোতা সমাজে। পরে বিটিভিতে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’ গান গেয়ে হইচই ফেলে দেন তিনি।

১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল এ দেশে প্রথম কনসার্ট হয় ওয়াপদা মিলনায়তনে উচ্চারণ-এর অংশগ্রহণে। তারপর ইন্দিরা রোডের ঢাকা রেকর্ড থেকে ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তার প্রথম রেকর্ড বের করেন আজম খান।

এভাবেই এই ব্যান্ডটি জন্ম দেয় ‘বাংলা পপ’-এর। তার গানগুলোতে আরো প্রকাশ পেত এই দেশের যুবকদের চিন্তাভাবনা। তিনি রাগের এবং হতাশার গান গাইতেন, যেটা যুবকরা তরুণ অবস্থায় অনেক বেশি অনুভব করে এবং এজন্যই তখনকার যুবকদের মন খুব তাড়াতাড়ি জয় করে ফেলতে পেরেছিলেন তিনি আর তার ব্যান্ড। তিনি এই গানগুলোর লিরিক্সগুলোতে বিভিন্ন সময়ে নিজের জীবনের বিভিন্ন কষ্ট এবং ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিফলন দেখিয়েছেন। তার গানগুলো তার আশপাশে বিভিন্ন ঘটে যাওয়া ঘটানার থেকেই আসত। একই সাথে তার বিভিন্ন গানে বিভিন্ন সময়ে নিজস্ব বিভিন্ন দর্শন, প্রতিবাদের কণ্ঠ বেজে উঠেছে।

তখনো বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেল আসেনি। তাই তিনি তার ব্যান্ড নিয়ে বিভিন্ন খোলা ময়দানে বা অডিটোরিয়ামে পারফর্ম করতেন। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি প্রায় যে-কোনো মানুষের মন জয় করে নিতে পারতেন তাঁর গানের মাধ্যমে। তারপর বাংলাদেশে টেলিভিশন এবং সর্বপ্রথম টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি বিস্তৃতি লাভ করার পর তিনি এবং তাঁর ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’-এর প্রথম শো বিটিভিতে সম্প্রচার করা হয়েছিল। সেই এক সম্প্রচার দিয়েই তিনি ব্যান্ড খ্যাতি অর্জন করে ফেলেন এবং  ‘পপসম্রাট’ উপাধি অর্জন করে নেন।

১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি সাহেদা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয় আজম খানের। সহধর্মিণী মারা যাওয়ার পর থেকে একাকী জীবন কাটান এ কিংবদন্তি। ১৯৮২ সালে ‘একযুগ’ নামে বাজারে তার প্রথম ক্যাসেট বের হয়। এরপর তার আরো অনেক ক্যাসেট ও সিডি আকারে বাজারে বের হয়। তার প্রথম সিডি বের হয় ১৯৯৯ সালের ৩ মে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে। তার ব্যান্ডের জীবদ্দশায় তারা শ্রোতাসমাজকে ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’, ‘আমি যারে চাইরে’, ‘আসি আসি বলে তুমি’, ‘অভিমানী’, ‘রেললাইনের বস্তিতে’, ‘আলাল ও দুলাল’সহ অসাধারণ বেশ কিছু গান উপহার দেন।

গুরু অনেক বাংলা চলচিত্রেও অভিনয় করেছেন। যেমন হীরামন (১৯৮৬) এবং গডফাদার (২০০৩)।

এছাড়া তিনি অনেক বিজ্ঞাপন ও মডেলিং ও করেছেন। ২০০৩ সালে ক্রাউন এনার্জি ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রথম মডেল হন। পরে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে দেখা যায় তাকে। সর্বশেষ ২০১০ সালে কোবরা ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনেও মডেল হন।

তিনি ২০১০ সালে ‘ওরাল ক্যানসার’-এ আক্রান্ত হন। ২০১১ সালের মে এর ২২ তারিখে ঢাকার ‘স্কয়ার হসপিটাল’-এ তাকে ভর্তি করানো হয় হাতে এবং কাঁধে ভীষণ ব্যথা দেখা দিলে। তার অবস্থা খারাপ হতে থাকলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় এবুং জুনের ১ তারিখে তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে নেয়া হয় যেখানে তিনি জুনের ৫ তারিখ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৬১ বছর। আজম খানকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। আজম খানের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালে প্রায় আট বছর পর উনাকে একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। খুব কম শিল্পীই পেরেছেন তাদের কাজের মাধ্যমে একটা প্রজন্ম নয়, একটা পুরো সময়ের মানুষের হূদয় স্পর্শ করতে এবং আজম খান সেসব শিল্পীদের অন্যতম এবং উল্লেখযোগ্য একজন। পরিশেষে এই বলবো শুভ জন্মদিন গুরু।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads