• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

হাঁসের খামার পরিচালনার পাশাপাশি জমি লিজ নিয়ে চাষবাস ও ছাগল পালনের মতো লাভজনক কাজ করেন হাওরবাসী

ছবি: সংগৃহীত

বাণিজ্য

অবকাঠামো উন্নয়নে বদলাচ্ছে হাওরের জীবনমান

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২৬ জুলাই ২০১৮

অভাবের সংসারে খাদ্য ও বস্ত্রের পূর্ণ নিশ্চয়তা না থাকায় বিদ্যালয়ে যেতে পারেননি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার সিকন্দরপুর গ্রামের করফুন্নেসা। স্বামী কাপ্তান মিয়ার ঘরেও সচ্ছলতা না থাকায় সন্তানদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে অল্প বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসিয়েছেন। শেষ বয়সে এসে একটি নার্সারির সুবাদে সচ্ছলতার মুখ দেখছেন করফুন্নেসা। স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি প্রকল্প থেকে নগদ ৪৬ হাজার টাকার সহায়তা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ সড়কের পাশে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নার্সারিটি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ নার্সারি থেকে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ১৪ হাজার টাকার চারা বিক্রি করেছেন। বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে আড়াই লাখ টাকার আরো প্রায় ২২ হাজার চারা। প্রতি মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হওয়ায় করফুন্নেসার পরিবারে এখন আর অভাব নেই। অভাবের কারণে নিজের ও সন্তানদের পড়াশোনা না হলেও নাতি-নাতনিদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারছেন তিনি।

হাওর এলাকায় করফুন্নেসার মতো অনেকেরই জীবনের গতিপথ বদলে দিচ্ছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের হাওর অঞ্চলের অবকাঠামো ও জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প। ৯৪৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরে নেওয়া প্রকল্পটি ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। ১৩ শতাংশ বাড়িয়ে প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হাওরপ্রধান ২৮ উপজেলার ১৭৬ ইউনিয়নে যোগাযোগ অবকাঠামো, সামাজিক অবকাঠামো, সামাজিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, জীবনমান সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজ করা হচ্ছে।

বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে এসে প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এ উপলক্ষে আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে বেসরকারি খাতের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনমাস কনসালট্যান্সি প্রাইভেট লিমিটেডের সহায়তায় প্রকল্প এলাকায় একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবাদে পাঁচ জেলার হাওর অঞ্চলে করফুন্নেসার মতোই বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনমানে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে বলে উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

প্রকল্পের আওতায় ডুবো রাস্তাসহ ১০০ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক নির্মাণ, দেড়শ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক নির্মাণ, একই পরিমাণের কমিউনিটি সড়ক নির্মাণ, উপজেলা রোডে ৭০০ মিটার সেতু নির্মাণ, ইউনিয়ন সড়কে ১ কিলোমিটারের বেশি সেতু নির্মাণ, কমিউনিটি সড়কে  দেড় কিলোমিটারের বেশি সেতু ও কালভার্ট, ৫০টি ল্যান্ডিং ঘাট নির্মাণ, ৭৮টি গ্রামীণ বাজার উন্নয়ন, ৯০টি মার্কেট কালেকশন সেন্টার নির্মাণ, ৭৮টি গ্রামে প্রতিরোধক, ২২৪টি গ্রামে প্রতিরক্ষা ও আন্তঃগ্রামীণ সেবা অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও ৩০৫টি বিল উন্নয়ন ১০০ কিলোমিটার খাল খনন ও ২ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ গাছের চারা রোপণের কাজ চলছে।

আইএমইডি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে প্রকল্পটির আওতায় ৬৫২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ১ হাজার ৭৬ কোটি ৩২ লাখ টাকার প্রকল্পে এ পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ৬৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হলে শেষ অর্থবছরে ব্যয় করতে হবে ৪২৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। তবে প্রকল্পের বেশ কিছু অংশের কাজ অনেক পিছিয়ে আছে বলে দাবি করেছে আইএমইডি।

এতে বলা হয়েছে, ১০০ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক উন্নয়নের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত সাড়ে ৮৬ কিলোমিটার রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। ৮০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ করতে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ৯৮ শতাংশ অর্থ। দেড়শ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়কে ১০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও ১০৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয় করে কাজ করা হয়েছে ১২৯ কিলোমিটার রাস্তার। ৯৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে কাজ হয়েছে মাত্র ৮৬ শতাংশ। কাজ শেষ করতে এ দুই খাতে বাড়তি অর্থ লাগবে। তা ছাড়া কমিউনিটি সড়ক উন্নয়নে বরাদ্দের ৯৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে কাজ হয়েছে মাত্র ৭৪ শতাংশ।

প্রকল্পের আওতায় উপজেলা সড়কে ব্রিজ নির্মাণের কাজও অনেক পিছিয়ে আছে। ৭০০ মিটার ব্রিজ নির্মাণে ২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ অংশের আর্থিক অগ্রগতি ৭ বছরে মাত্র ২৭ শতাংশ। আর ব্রিজ নির্মাণের কাজ হয়েছে ২৭৯ মিটার, যা লক্ষ্যমাত্রার ৪০ শতাংশ। ইউনিয়ন সড়কে ব্রিজ নির্মাণের কাজে আর্থিক অগ্রগতি ৩৭ শতাংশ। আর এ অংশের মাঠ পর্যায়ে কাজ হয়েছে ৪৭ ভাগ। কমিউনিটি সড়কে সেতু নির্মাণের কাজে বরাদ্দের ৪৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে অগ্রগতি হয়েছে ৩৯ শতাংশ।

হাওর অঞ্চলের উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ হিসেবে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছে আইএমইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পে রাজস্ব খাতের আওতায় মোট ৭৩ কর্মকর্তার চাহিদার বিপরীতে নিয়োজিত আছেন মাত্র ৯ জন। জেলা বাস্তবায়নকারী অফিসের ২৫ পদের মধ্যে আছেন মাত্র ১ জন। উপজেলা বাস্তবায়নকারী অফিসের ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদই শূন্য রয়েছে।

তা ছাড়া প্রকল্পটির অবকাঠামো অংশের স্থানীয় শ্রমিক ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকায় কাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, হাওর অঞ্চলে বন্যার কারণে কাজ করায় অসুবিধা থাকে। শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষে ব্যস্ত থাকে শ্রমিকরা। সরকারি প্রকল্পে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় দৈনিক ৩০০ টাকা। ধান কাটার  মৌসুমে শ্রমিকদের মজুরি অনেক বেশি। এর ফলে অগ্রিম নিয়েও অনেকেই প্রকল্পের কাজে আসতে চায় না।

ব্যবস্থাপনার অভাব সত্ত্বেও প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে অনেকেই ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছেন বলে জানিয়েছে আইএমইডি। তাদেরই একজন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করা নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার মূল পোগড়া গ্রামের রিক্তা খাতুন। সময়ের ব্যবধানে তার এখন দৈনিক আয় ৩ হাজার টাকা। প্রকল্পের আওতায় হাঁসের মিনি হ্যাচারি স্থাপনের সুবাদে তার এখন সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পরিমাণ ৯ লাখ টাকা। ২০ হাজার টাকার সহায়তা নিয়ে হ্যাচারি স্থাপন করা রিক্তা খাতুন এখন হাঁসের খামার পরিচালনার পাশাপাশি জমি লিজ নিয়ে চাষবাস ও ছাগল পালনের মতো লাভজনক কাজে নিয়োজিত আছেন।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার রাধানগর গ্রাম সবজির গ্রামে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে ছয় মাসের বেশি পানিতে ডুবে থাকা এ গ্রামের দেড়শ পরিবারের মধ্যে ৮০টি এখন সবজি চাষে সংশ্লিষ্ট। আইএমইডি জানায়, প্রকল্পের আওতায় গ্রামটির ২৫ চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনজনকে প্রদর্শনী প্লটের জন্য নির্বাচন করা হয়। তিন প্লটে চাল কুমড়া ও ঝিঙা চাষে উচ্চ মুনাফায় প্রভাবিত হয়ে গ্রামের চাষিরা এখন সারা বছর সবজি চাষ করছেন। এর ফলে কৃষি খাতে শ্রমিকের চাহিদা ও মজুরি বেড়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। ২০১৬ সালে জুটব্যাগের কারখানা স্থাপন করে মাত্র দুই বছরের মাথায় সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নাম লিখিয়েছেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম শোলাচরের হতদরিদ্র অর্চনা দাস। প্রকল্পের আওতায় ১০ দিনের প্রশিক্ষণ ও ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে স্থাপিত কারখানা থেকে এখন মাসে লাভ আসছে ১৫ হাজার টাকার বেশি। পরিবারের খরচ মিটিয়েও তার মাসে সঞ্চয় হচ্ছে ৫ হাজার টাকার বেশি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads