• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
বৃষ্টিপাত বাড়বে জনদুর্ভোগ

ছবি : সংগৃহীত

আবহাওয়া

বৃষ্টিপাত বাড়বে জনদুর্ভোগ

  • এ এইচ এম ফারুক
  • প্রকাশিত ২৯ জুন ২০১৯

নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞদের অভিমত—

বছরজুড়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি না করে, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পলিথিনের অবাধ ব্যবহার বন্ধ করা এবং রাজধানীর খাল-নদী উদ্ধার করে গতিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে পারলে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব

১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় সারা দেশের মতো আক্রান্ত হয় রাজধানী ঢাকাও। ফলে রাজধানীকে বন্যা থেকে রক্ষায় সে সময় ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের পেছন থেকে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের নবাবগঞ্জ, হাজারীবাগ, রায়ের বাজার, গাবতলী, মিরপুর হয়ে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় রাজধানী ঢাকায় পানি ঢুকতে পারেনি।

কিন্তু বর্তমানে সংস্কারের অভাবে এসব বাঁধের ১৪ কিলোমিটারজুড়ে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। বাঁধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। একদিকে বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে মাটির ধস, ড্রেনেজ ব্যবস্থা দুর্বল ও ভেতরের খাল এবং নালা দখলের ফলে ২০১৭ সালে বৃষ্টিতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় ভুগতে হয় রাজধানীবাসীকে। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা রাজধানীবাসী এখনো ভোলেনি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর বিগত বছরগুলোর চেয়েও অধিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, ঢাকাসহ দেশের কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে।

এদিকে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার ভোগান্তির অবসান ঘটাতে সরকার বার বার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতি শেষ হয় না কখনো। ফলে চলতি বর্ষায় জলাবদ্ধতার দীর্ঘ ভোগান্তির আশঙ্কায় রয়েছে রাজধানীবাসী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো খনন এবং ভেতরের খালগুলো দখলমুক্ত ও সংস্কার না করা, অধিকাংশ সড়কে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজে খোঁড়াখুঁড়িসহ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলায় ড্রেনের পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতার কারণে এ বছর রাজধানীতে রেকর্ড পরিমাণ জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকার চারপাশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বেহাল অবস্থার কারণে ঝুঁকির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার সামান্য বৃষ্টিপাত এবং নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। গত কয়েক বছর ধরে অল্প বৃষ্টিতেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জমে যায় হাঁটু পানি। আবার কোথাও কোথাও অবাধে নৌকা চলাচল করতেও দেখা গেছে।

এ মৌসুমে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে, পাশাপাশি আশপাশের নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে শহরে ঢুকে পড়লে রাজধানীবাসী চরম দুর্ভোগে পড়তে পারে এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) এ আশঙ্কা বেশি বলে জানিয়েছে ঢাকা ওয়াসা ও ডিএসসিসির দায়িত্বশীল সূত্র।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে মোট ভূমির ১২ শতাংশ জলাধার থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ২ শতাংশ। তাই বৃষ্টির সময় অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার জায়গা নেই। অন্যদিকে ঢাকা শহরের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কংক্রিটে ঢাকা। তাই মাটির নিচে পানি যাওয়ার পথও বন্ধ। আগে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে বিশাল জায়গাজুড়ে জলাধার ছিল। বৃষ্টির পানি সেখানে গিয়ে পড়ত। পরে বিভিন্ন খাল দিয়ে সেই পানি পৌঁছাতো বালু নদে। এখন এসব খাল ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। পরিষ্কার করলেও অল্প‌দিনেই আবার আবর্জনায় ভরে যায়। ফলে ভারী বৃষ্টিপাতের পানি বিভিন্ন সড়কেই আটকে থাকে। আর ঢাকার চারপাশের নিম্নাঞ্চল ভরাট হয়ে যাওয়ায় শহরের ভেতর থেকে পানি স্বাভাবিকভাবে নিষ্কাশন হতে পারছে না। এসব কারণেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সূত্রমতে, মতিঝিল ও আশপাশের এলাকার বৃষ্টির পানি টেনে নিতে পাম্প স্টেশনের যে ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, তা নেই।

ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, এ এলাকার পানি যাওয়ার একটিই পথ (আউটলেট) আছে জনপদে। সেখানে ওয়াসার তিনটি পাম্প আছে। এগুলোর পানি টানার সার্বিক ক্ষমতা প্রতি ঘণ্টায় ৫৪ হাজার কিউবিক মিটার; কিন্তু প্রয়োজন ১ লাখ কিউবিক মিটারের বেশি। ফলে ৬০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে মতিঝিলসহ আশপাশের পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতা হবেই। তিনি অবশ্য বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় পাইপলাইন ও ভূ-উপরিস্থ মিলে প্রায় যে ১ হাজার কিলোমিটার নর্দমা রয়েছে, তা নিয়মিত পরিষ্কার রাখা হচ্ছে।

এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কিছু এলাকায় এবার জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সমস্যাটি পুরোপুরি নিরসন হবে না। গুলশান ও বাড্ডায় ডিএনসিসি পর্যাপ্ত গভীর নর্দমা নির্মাণ করেছে। আগারগাঁওয়ে কিছু কাজ বাকি। এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে বরাবরের মতো মিরপুর এলাকায় জলাবদ্ধতা হবে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান জানান, সারা দেশে ৭০টি জোনের মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উপকূলীয় বাঁধ, ডুবন্ত বাঁধ এবং সেচ খালের বাঁধের মেরামত কাজ চলমান রয়েছে। আসলে বরাদ্দ কম থাকার কারণে এ অধিদপ্তরে কাজ করা যাচ্ছে না। ২০১৭ সালের মতো বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা হলে এই মৌসুমে আরও বেশী দূর্ভোগে পারতে হবে রাজধানীবাসী।

নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, যত্রতত্র ময়লা ফেলায় ড্রেনেজ আবদ্ধতা, বছরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাজধানীর খালগুলোর বেদখল ও খননের ব্যবস্থা না করা, পলিথিন বর্জ্যের অবাধ ব্যবহার রাজধানীর জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী।

এ ছাড়া অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। যেমন ওয়াসা, গ্যাস, রাস্তা সংস্কারসহ মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজে সড়কগুলো খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও এ বছর রাজধানীতে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হবে রাজধানীবাসীকে।

তিনি বলেন, শুধু বেড়িবাঁধের কারণেই নয়, ঢাকা শহরের পানি বের হওয়ার জন্য যেসব খাল ছিল সেগুলো আজ অস্তিত্বহীন। যে কয়টি খালের সামান্য অস্তিত্ব আছে, সেগুলোও দখলে-দূষণে মৃতপ্রায়। ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাও এখন অকার্যকর। রাজধানীজুড়ে চলছে ড্রেন সংস্কারের কাজ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান বলেন, ড্রেনেজ সংস্কার করেও ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ১২০০ কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানীর সড়কগুলো পানিতে থৈ থৈ করে। পবার তথ্য অনুসারে, শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন দুই কোটি পরিত্যক্ত পলিথিন জমছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পলিথিনকে ঢাকার জলাবদ্ধতার জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পবা।

আরো জানা যায়, ঢাকার অনেক খাল যেমন দখলে-দূষণে বিলীন হয়ে পড়েছে, তেমনি এর চারপাশের নদীগুলোও এখন মৃতপ্রায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা নিষ্প্রাণ। দখলে ও বর্জ্যদূষণে এগুলো স্রোতহীন। এ ছাড়া দখলের ফলে বালু নদ এখন প্রায় মৃত। এসব নদী দিয়ে ঢাকার পানি প্রবাহিত হয়। এসব নদীর প্রবাহ না থাকায় রাজধানীর পানি সহজে বের হতে পারে না। ঢাকা মহানগর এলাকায় ৫৮টি খাল চিহ্নিত করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ৩৭টি খালের অংশবিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন দখল করে নিয়েছে। যে কারণে খালগুলোর গতি আর স্বাভাবিক নেই।

তাই বছরজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি না করে, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পলিথিনের অবাধ ব্যবহার বন্ধ করা এবং রাজধানীর খাল ও নদী খনন করে সেগুলোর গতিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনাসহ যুগোপযোগী ড্রেনেজ ব্যাবস্থা হাতে নিলে রাজধানীবাসী জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads