• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
রাজধানীর সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ লেগুনা

অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা লেগুনা স্ট্যান্ড

ছবি : বাংলাদেশের খবর

যোগাযোগ

রাজধানীর সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ লেগুনা

অধিকাংশ চালক হেলপারের বয়স ১৮ বছরের নিচে

  • রানা হানিফ
  • প্রকাশিত ১৫ জুলাই ২০১৮

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড্ডা লিঙ্ক রোড রুটে হিউম্যান হলারের (লেগুনা) চালক শফিকুল। বয়স ১৬ বছর। এই কিশোরের হাতে জীবন সঁপে দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করছে শত শত অসহায় সাধারণ যাত্রী। আর এই শফিকুলের সহকারী হিসেবে লেগুনার পেছনে সারাটা দিন ‘ঝুলে’ থাকে রায়হান। যার বয়স ১০ বছরও পার হয়নি। প্রচলিত আইন অনুযায়ী শফিকুল ও রায়হান এখনো শিশুদের কাতারেই রয়েছে। জেনেশুনেই এসব শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মোটরযানের স্টিয়ারিং।

সংসদে পাস হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭’-এর খসড়া অনুযায়ী চালকের নিবন্ধন পেতে একজন ব্যক্তির সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর। আর পেশাদার চালকদের ক্ষেত্রে সেই বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ বছর। বিদ্যমান ‘দ্য মোটর ভেহিকল অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩’ অনুযায়ীও চালকের নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্যতার নিম্ন বয়সসীমা ১৮ বছর নির্ধারণ করা রয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে নিবন্ধিত হিউম্যান হলার বা লেগুনার সংখ্যা ৫ হাজার ১৫৬টি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীতে চলাচলকারী অধিকাংশ লেগুনার চালকেরই বয়সসীমা ১৮ বছরের নিচে। মোহাম্মদপুর থেকে বাড্ডা লিঙ্ক রোড, ফার্মগেট ইন্দিরা রোড এই রুটের মোট ১৫ জন চালকের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায় ৯ জনেরই বয়সসীমা ১৮ বছরের নিচে, বাকি ৬ জনের বয়সসীমা ১৮ বছরের ওপরে হলেও তাদের মধ্যে মাত্র ২ জনের আছে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স। আর এসব লেগুনার সহকারীর (হেলপার) দায়িত্বে থাকা ১৫ জনেরই বয়স ছিল ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে। সহকারী হিসেবে নিবন্ধন নিতে হয় এমন তথ্যটিও জানা নেই চালক বা এসব শিশু হেলপারের।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট (রিং রোড) থেকে ফার্মগেট ইন্দিরা রোড রুটে এক বছর ধরে লেগুনা চালায় ১৬ বছর বয়সী কিশোর নিজামুল। এর আগে সে প্রায় দুই বছর বিভিন্ন রুটে হিউম্যান হলারের সহকারী হিসেবে কাজ করেছে। সহকারী হিসেবে কাজ করা অবস্থাতেই গাড়ি চালানোর হাতেখড়ি নিজামুলের। সহকারী থাকা অবস্থাতেই গভীর রাতে কিংবা খুব ভোরে দু-একটা ট্রিপ দেওয়ারও সুযোগ পেত নিজামুল। গত এক বছর ধরে লেগুনার চালক হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে সে।

নিজামুল বাংলাদেশের খবরকে বলে, ঢাকার কোনো লেগুনাতেই হেলপার থাকে না। মহাজন (মালিক) ড্রাইভারকে গাড়ি দেয়। আর ড্রাইভারই হেলপার ম্যানেজ করে। লেগুনা স্ট্যান্ডগুলোতে গেলে দেখবেন ছোট ছোট ছেলেরা বসে আছে। সেখান থেকেই দিন চুক্তি, ট্রিপ চুক্তিতে হেলপার হিসেবে নেওয়া হয়। মালিকের জমার পর যে টাকা থাকে সেখান থেকে হেলপারকে বেতন দিয়ে বাকিটা ড্রাইভারের থাকে।

বয়স আর ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার জন্য ট্রাফিক পুলিশ আটকায় কি না এমন প্রশ্নে নিজামুল বলে, সিগন্যাল না মানলে, রং সাইডে গেলে মাঝে মাঝে আটকায়। তখন গাড়ির কাগজ নিয়ে মামলা করে দেয়, ড্রাইভিং লাইসেন্স চায় না। লেগুনার সব ড্রাইভারই আমার বয়সী, কারোই লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স থাকলে লেগুনা চালাব কেন, তখন বাস চালাব।

তবে লেগুনার শিশু চালক দেখার পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাতে চড়ছে সাধারণ যাত্রীরা। এমনকি ব্যস্ততার অজুহাতে অনেকেই ঝুলছে এসব লেগুনার পেছনে। ফার্মগেট থেকে আগারগাঁও ৬০ ফিট রুটের এক শিশু চালকের পাশের সিটেই চড়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী আমিরুল ইসলাম আরজু। তিনি বলেন, ফার্মগেট থেকে ৬০ ফিট রুটে লেগুনা ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি নেই। কোনো উপায় নেই আমাদের। বাচ্চারা লেগুনা চালাচ্ছে এগুলো দেখেই চড়ছি। এগুলো যাদের দেখার কথা, যাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তারা তো কিছুই করছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের এক উপকমিশনার বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখে দেখে যদি রাজধানীতে ট্রাফিক সার্জেন্টরা দায়িত্ব পালন করতে যান তাহলে শুধু লেগুনা নয়, অর্ধেক বাসই বন্ধ হয়ে যাবে। আর বিভিন্ন কারণে লেগুনার বিরুদ্ধে অভিযান নেওয়া সম্ভব হয় না। অধিকাংশ লেগুনারই রুট পারমিট নেই। এটা তো দেখবে বিআরটিএ। অথচ তারা নিশ্চুপ। তারাও তো অভিযান চালায় কিন্তু লাভ হয় না। লেগুনার ড্রাইভার অধিকাংশই শিশু, এটা আমরাও দেখছি। কিন্তু এই শিশুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বা গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দিলেও কি সমাধান হবে?

বিআরটিএ’র পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। আমরা জেল-জরিমানাও করছি। অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। খসড়া যে সড়ক পরিবহন আইন রয়েছে সেটা পাস হওয়ার পর এমন চিত্র থাকবে না। তখন শিশুদের দিয়ে যানবাহন চালালে মালিকের বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মোসলেহ উদ্দিন হাসান বলেন, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গণপরিবহন চালানো দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধ চালক-মালিক দুজনই করছেন। নিয়ন্ত্রণ না করা হলে এই পেশায় শিশুদের সম্পৃক্ততা আরো বাড়বে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads