• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
বড় কোম্পানি বড় খেলাপি!

দেশের ১০টি পরিবহন কোম্পানির কাছে মোট খেলাপি ঋণের সিংহভাগ আটকে আছে

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

বড় কোম্পানি বড় খেলাপি!

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ১৬ আগস্ট ২০১৮

পরিবহন খাতে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের দুই-তৃতীয়াংশই প্রভাবশালীদের পকেটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, এই খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত পরিবহন খাতের সব নিয়ন্ত্রণ সরকারদলীয় প্রভাবশালী ও তাদের সমমনা ব্যবসায়ীদের হাতে। প্রভাব খাটিয়ে তারা ব্যাংকঋণের অর্থ ফেরত দেন না। পরিবহন খাতে খেলাপি ঋণ যেন ব্যাংকগুলোর জন্য বড় বোঝা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, দেশের ১০টি পরিবহন কোম্পানির কাছে মোট খেলাপি ঋণের সিংহভাগ আটকে আছে। এর মধ্যে হানিফ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, এনা পরিবহন, গ্রিন লাইন, স্টার লাইন, সেন্টমার্টিন, ন্যাশনাল ট্রাভেলস অন্যতম। এই ১০ পরিবহন কোম্পানির খেলাপি ঋণ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ব্যাংকগুলোর সতর্ক হয়ে পরিবহন খাতে অর্থায়ন করা উচিত। তবে সেটি করা কঠিন। কারণ পরিবহন মালিকরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। এমনকি শোনা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও এর সঙ্গে জড়িত। তাই ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই না করে অনেকটা বাধ্য হয়ে এ খাতে বিনিয়োগ করে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সংশ্লিষ্টদের চূড়ান্ত গাফিলতি, আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়া, সুশাসনের ঘাটতি, উচ্চ পর্যায়ের সিন্ডিকেটসহ নানা জটিলতায় এ খাতের কাছে মানুষ জিম্মিদশায় রয়েছে। পুরো খাতটি অনিয়মের বেড়াজালে বন্দি। তবে পরিবহন খাতে অর্থায়ন করার আগে ব্যাংকগুলো আরো সতর্ক হতে পারে।

বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, পরিবহন খাতের সব ব্যবসায়ী খারাপ সেটি বলা যাবে না। অনেকেই ঠিকমতো ঋণ পরিশোধ করছেন। অনেকে সেটি করেন না। দেশের বিশাল এ খাতে সব ধরনের ব্যবসায়ী রয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি এনা পরিবহনের মালিক। বর্তমানে দেশজুড়ে তার গাড়ি চলছে। মূলত বর্তমান সরকারের আমলে বেশি ব্যবসা বাড়িয়েছেন এনায়েত উল্লাহ। এই পরিবহন মালিক নেতা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সহ-সভাপতি হিসেবে রয়েছেন। বলা হয়, পরিবহন খাত যে কয়েকজন ব্যক্তির কব্জায়, তাদের একজন এনায়েত উল্লাহ। এনা পরিবহন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এই পরিবহন কোম্পানিকে ঋণ দিয়ে বিপদে পড়েছে কয়েকটি ব্যাংক।  

দেশের পরিবহন খাতে বড় নাম হানিফ পরিবহন। এ পরিবহনে গাড়ির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার বলে এর কর্মীরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া গড়ে তুলেছেন পেট্রোল পাম্প। বর্তমানে গ্রুপটির কাছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে তিন শ কোটি টাকা। এর উদ্যোক্তা জয়নাল আবেদীন হানিফ। তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি। ফলে পরিবহন কোম্পানিটি এখন প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এ খাতে এখনো শক্ত অবস্থানেই আছে। শ্যামলী পরিবহনের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ৪৫টি জেলায় বাস সার্ভিস রয়েছে গণেশ চন্দ্র ঘোষের এই কোম্পানির। আন্তর্জাতিক রুটেও চলছে শ্যামলীর গাড়ি। গ্রিন লাইন পরিবহনের খেলাপি ঋণ ৮০০ কোটি টাকা। পরিবহন কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মো. আলাউদ্দিন।

হিসাব বলছে, স্টার লাইন, সেন্টমার্টিন, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, দেশ ট্রাভেলস, একে ট্রাভেলসের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকা। এসব কোম্পানির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীনদের মদত রয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, রাজধানীসহ দেশের পরিবহন খাত ও শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীনদের হাতে। আর তাদের হাত ধরে শ্রমিক থেকে মালিক বনে গেছেন অনেক পরিবহন ব্যবসায়ী। তারাও রাতারাতি বাসের মালিক হয়েছেন। প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ব্যবসা করছেন। কিন্তু ব্যাংকের দায় পরিশোধ করছেন না। বড় কোম্পানিগুলোর বাইরেও এভাবে বড় অঙ্কের খেলাপি দাঁড়িয়েছে এই খাতে।

তবে বিএনপির শাসন আমলে পরিবহন ব্যবসা ছিল মির্জা আব্বাসসহ কয়েকজনের দখলে। তার নেতৃত্বে চলেছে ঢাকা পরিবহন। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে বিএনপির প্রভাবশালীদের কোম্পানিগুলো আর টিকতে পারেনি। তাদের কাছেও ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের অর্থ আটকে আছে। কিন্তু অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ওইসব কোম্পানিকে দেওয়া ঋণ আর আদায় হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও বেনামে রাজধানী ও আন্তঃজেলায় বাস নামিয়ে ব্যবসা করছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, ব্যাংকগুলো পরিবহন খাতের মালিকদের কাছে পাবে ১৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের এই পরিমাণ এসেছে পরিবহন খাত থেকে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের প্রায় ১৬ শতাংশই পরিবহন খাতের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের হারের থেকে পরিবহন খাতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। বর্তমানে পরিবহন খাতে মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলো পরিবহন খাতের মালিকদের দিয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads