• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
অবৈধ লেভেল ক্রসিং সহস্রাধিক

ছবি : সংগৃহীত

যোগাযোগ

অবৈধ লেভেল ক্রসিং সহস্রাধিক

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই ২০১৯

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় অরক্ষিত একটি লেভেল ক্রসিংয়ে গত সোমবার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বর-কনেসহ ১১ জন। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বারইয়ারহাট এলাকায় বাসের সঙ্গে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যান দুজন। ২০১৪ সালের ১ আগস্ট ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় বরযাত্রীবাহী একটি বাসের সঙ্গে ট্রেনের ধাক্কা লেগে প্রাণ হারান ১১ জন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে অরক্ষিত অবস্থায় থাকা লেভেল ক্রসিংগুলোয় প্রায়ই এ ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। তখনই নড়েচড়ে বসে ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টরা। পরে সব আগের মতো হয়ে যায়। এর মধ্যে রেল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছর রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি ঘটে, তার সিংহভাগই লেভেল ক্রসিংয়ে। তারা জানান, সারা দেশে রেলওয়ের অবৈধ লেভেল ক্রসিং আছে ১ হাজার ৮৫টি। এর কোনোটিতেই গেটকিপার নেই। শুধু পারাপারের পথে ‘ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিং’ লেখা সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে।

এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে অনুমোদিত ও অনুমোদনহীন দুই হাজারের বেশি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এসব লেভেল ক্রসিংয়ের বেশিরভাগেরই প্রতিবন্ধক কিংবা গেটম্যান নেই। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, যে কারণে এগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে।

এর মধ্যে দেশের বিদ্যমান অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো কারা কখন নির্মাণ করেছে তা অনুসন্ধান করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, অরক্ষিত অবৈধ লেভেল ক্রসিং বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থা রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই যথাযথ নিয়ম অনুসরণ না করে তৈরি করেছে।

মজার কিংবা কষ্টের বিষয়— রেলওয়ের ভূসম্পত্তি শাখার তথ্য বলছে, রেলপথে সবচেয়ে বেশি অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সারা দেশে ৪৫২টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং আছে তাদের। একইভাবে ইউনিয়ন পরিষদের ৩৬৩, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ১১, পৌরসভার ৭৯, সিটি করপোরেশনের ৩৪, জেলা পরিষদের ১৩, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ৩, বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের ১, জয়পুরহাট চিনিকলের ১, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ৩, অন্যান্য ৯২ এবং রেলওয়ে মালিকানা জানতে পারেনি এমন অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা আরো ৩৩টি। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর সিংহভাগই গড়ে উঠেছে রেলের পূর্বাঞ্চলে। এ সংখ্যা ৮১১।

শুধুই কি অবৈধ, জনবলের অভাবে অনেক বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না রেলওয়ে। রেলওয়ের দুই জোনে (পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল) বৈধ লেভেল ক্রসিং আছে ১ হাজার ৪১২টি। এর মধ্যে গেটকিপার আছে মাত্র ৪৫৬টিতে। বাকিগুলোয় ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে যানবাহন। বৈধ, কিন্তু গেটকিপার নেই, এমন লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা পশ্চিমাঞ্চল (রাজশাহী) রেলওয়েতে বেশি। ৯৭৮টি বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে গেটকিপার আছে মাত্র ২২১টিতে। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলে (চট্টগ্রাম) ৪৩৪টির মধ্যে গেটকিপার আছে ২৪৫টি লেভেল ক্রসিংয়ে।

এদিকে বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিং পুনর্বাসনে রেলওয়ের দুটি জোনে পৃথকভাবে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এর আওতায় পূর্বাঞ্চলে ৩২৮টি অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে গেটকিপার নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান। এগুলোর মধ্যে বৈধ লেভেল ক্রসিং আছে ১৮২টি, বাকি ১৪৬টি অবৈধ। এ পর্যন্ত ৮১৭ জন গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের ২৮৬টি লেভেল ক্রসিংয়ে পদায়ন করা হয়েছে। আরো ২২১ জনকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান।

অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে ৩২৬টি অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ৮৫১ জন গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে ৬৩৯ জনের পদায়নও হয়ে গেছে। বাকি পদগুলোতেও নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছে বলে জানা যায়।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ শতাধিক মামলা করেছে, যেগুলো এখন বিচারাধীন আছে। সড়ক পরিবহন বিভাগের মোটর ভেহিকেল আইনের ২৪ ধারায় বলা আছে, ‘রেললাইনের ওপর দিয়ে পার হওয়ার সময় ধীরে এবং দেখে পার হতে হবে।’ এই ধারা কেউ মানে না বলেই দুর্ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, গত বছর রাজধানীর সায়েদাবাদে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন-বাস সংঘর্ষের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ে উড়াল সেতু নির্মাণের সুপারিশসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- ক্রসিং গেটের আশপাশে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা, লোকবল বাড়ানো, গেটম্যানের স্থায়ী পদ সৃষ্টি ও উড়াল সেতু নির্মিত হলে তার পাশে দেয়াল তুলে দেওয়া, ট্রাফিক সার্জেন্ট মোতায়েন, যতদিন গেটম্যান স্থায়ী না হয়, ততদিন গেটম্যানের পারিশ্রমিক বর্তমানের ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১৬০ টাকা করা। দীর্ঘ এক বছরেও এসব সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।

রেলের উপ-মহাপরিচালক (এডিজি) অপারেশন মিয়া জাহান জানান, প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথে যে কোনো স্থানে অনুমোদন না নিয়েই লেভেল ক্রসিং বানাচ্ছে স্থানীয় জনসাধারণ। এ কারণে ট্রেনগুলো নির্ধারিত গতিতে চলতে পারে না, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটেছে, মারা যাচ্ছে মানুষ। তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত রেলের প্রায় হাজারখানেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। এসব দুর্ঘটনায় ১২৫ জন মারা গেছে। এর মধ্যে শুধু অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে ১১০ জন (নথিভুক্ত) মারা গেছে। যার মধ্যে ২০১৪ সালে ৫৪ জন, ২০১৫ সালে ১৩ জন, ২০১৬ সালে ১১ জন, ২০১৭ সালে ১৫ জন, ২০১৮ সালে ১৩ জন মারা গেছে বলে জানান তিনি।

রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান বলেন, সারা দেশে সহস্রাধিক অবৈধ লেভেল ক্রসিং গড়ে উঠেছে। এগুলো বানিয়েছে এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর। রেললাইনে লেভেল ক্রসিং বানাতে হলে আমাদের অনুমোদন নেওয়া লাগে। এছাড়া নির্দিষ্ট হারে ডিপোজিট মানি জমা দিতে হয়। কিন্তু এসব সরকারি সংস্থা নিজেদের ইচ্ছামতো আমাদের না জানিয়েই অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বানিয়েছে।

কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী মামলা করতে পারি। কিন্তু বেশির ভাগই যেহেতু সরকারি সংস্থা, সেহেতু মামলার ঝামেলায় আমরা জড়াতে চাই না। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের আসলে তেমন কিছু করারও নেই।

রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, জনবলের অভাবে অনেক বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে গেটকিপার রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও আমরা স্বয়ংক্রিয় লেভেল ক্রসিং ব্যবহারের পরিকল্পনা করছি। বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বিএনপি সরকার রেললাইনের উন্নয়নে কোনো কাজ করেনি বরং তারা রেললাইন তুলে ফেলেছে। এ ছাড়া এ সময় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে কর্মী ছাঁটাই করা হয়। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে কর্মী সংকটও রয়েছে। তা ছাড়া অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়েছে অনেকগুলো। যার কোনো অনুমোদন নেই। যার ফলে সব ক্রসিংয়ে কর্মী দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে অবৈধ ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে যাতে আর প্রাণহানি না ঘটে সে কারণে আগামীতে ১৩শর মতো গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া হবে। এ নিয়োগ সম্পন্ন হলে গেটের সমস্যা মিটে যাবে। তিনি জানান, অনেক স্থানে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের ফলে রেলের দুর্ঘটনা বাড়ছে, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক। এসব অবৈধ ক্রসিং যারা বানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads